রমজানে কদর বেড়েছে হালিমের

এমনিতেই বাঙালি ভোজনরসিক জাতি, তার উপর রমজান এলেতো কথাই নেই! ঘটা করে চলে ইফতার আয়োজন। আর এই বাহারি ইফতার আয়োজনে হালিম না থাকলে যেন পূর্ণতা অনুভব করা কঠিন ব্যাপার হয়ে যায়। তাই ছোট থেকে বড়, ধনী বা গরীব সবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন পদের ও দামের হালিম। তবে মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, একসময় যে হালিম ছিল পুরান ঢাকার বনেদি মানুষের ঘরের খাবার, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপি। হয়ে উঠেছে ইফতারির বাজারের অন্যতম সেরা আইটেম।

সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি ইফতার বাজার ঘুরে দেখা যায়, রান্নার কলাকৌশল ও বৈচিত্র্যময় নামের কারণে ঢাকাই হালিম এখন বেশ প্রসিদ্ধ। তাই রমজানে প্রতিদিনই দুপুরের পর থেকে রকমারি হালিমের গন্ধে ম-ম করে ঢাকার ইফতারি বাজার। এর মধ্যে কোনো কোনো হালিমের ঐতিহ্য অর্ধশতাব্দি পুরনো। তেমনি কারও কারও হালিম তৈরির ঐতিহ্যও রয়েছে বংশ পরম্পরায়।

হালিমের নামের বৈচিত্র্যতা:
হালিমের নামেও রয়েছে বৈচিত্র্য। মামা হালিম, চাচা হালিম, পাঞ্চু ফকিরের হালিম, নূরানি হালিম, রজ্জবের হালিম, বিক্রমপুর হালিম, আম্বালা হালিম, নর্থসাউথ রোডে রাজ্জাকের শাহি হালিম, ফখরুদ্দীন বাবুর্চির ইফতারের শাহি মুরগি, খাসি ও গরুর হালিম, মতিঝিলে হীরাঝিলের শাহি হালিম এবং ঘরোয়ার শাহি হালিম উল্লেখযোগ্য।

ঢাকায় যেসব হালিম পাওয়া যায়:
ঢাকায় যেসব হালিম তৈরি হয় তার মধ্যে রয়েছে- শাহি হালিম, ঢাকাই হালিম, স্পেশাল হালিম, মিক্সড হালিম ইত্যাদি। এছাড়া গরুর মাংসের হালিম, খাসির মাংসের হালিম, মুরগির মাংসের হালিম এবং কবুতরের মাংসের হালিম উল্লেখযোগ্য।

চকের শাহী হালিম:
শাহী হালিমের জন্য বিখ্যাত দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে চকবাজারের আল রাজ্জাক, ডিসেন্ট, নিউ নূরানী, আনন্দ প্রভৃতি। প্রতিটি দোকানের হালিম স্বাদে ও গন্ধে আলাদা।

নিউ নূরানীর বাবুর্চী রসুলের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, মুগ, মসুর, মাসকলাই ডালের সঙ্গে নানা ধরনের মসলা এবং পরিমাণমতো টক দই, গরু ও খাসি এবং মুরগির মাংস কেটে বা টুকরো দিয়ে সিদ্ধ করে তৈরি হয় এ শাহি হালিম। পরিবেশনের সময় আরেকবার সালাদ ও পুদিনা পাতা মেশানো হয়। ছোট-বড় মাটির ভাড়ে বিক্রি হয় এ হালিম। মাংস ও পরিমাণভেদে হালিমের মূল্য ১২০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি।

পাঞ্চু ফকিরের হালিম:
পুরান ঢাকার নামকরা হালিম হলো পাঞ্চু ফকিরের হালিম। চকবাজারের রায়সাহেব বাজারের বটগাছের নিচে খুবই সাদামাটাভাবে বিক্রি হয়। ৪১ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ হালিম তৈরি হয়ে আসছে। এর আসল কারিগর পাঞ্চু ফকির মারা গেছেন ১৬ বছর আগে। এখন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তারই ছেলে লাল মিয়া।

তিনি জানান, প্রতিদিন মাত্র এক ডেকচি হালিম রান্না করেন তারা। রান্না হয় রায়সাহেব বাজারের তিন নম্বর বাড়িতে। তারপর তা ঠিক ইফতারের দুই-তিন ঘণ্টা আগে নিয়ে আসা হয় বটগাছের নিচে। এক বাটি হালিমের দাম ৭৫ টাকা। যতই চাহিদা থাকুক, এক ডেকচির বেশি রান্না হয় না কিছুতেই।

ঢাকাই হালিম:
ঢাকাইয়া হালিম বলতে মূলত প্লাস্টিকের বাটিতে যে সব হালিম বিক্রি করা হয় সেগুলোকেই বোঝায়। যদিও শাহী হালিম ও ঢাকাইয়া হালিমের তৈরির পদ্ধতিতে খুব একটা ভিন্নতা নেই। তারপরও এলাকা ভিত্তিক বিক্রির কারণে এই হালিমের নামের ক্ষেত্রের এই ভিন্নতা।

বেইলি রোড:
বেইলি রোডে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঢাকাইয়া হালিমের দোকান। তবে এর মধ্যে ক্রেতাদের বেশি উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ক্যাপিটাল কনফেকশনারিতে। এখানে খাসির হালিম ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, মুরগীর হালিম ৩০০ থেতে ৬০০ টাকা।

ক্যাপিটাল কনফেকশনারির কর্ণধর মুহাম্মদ জালাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তাদের এখানকার হালিমের বিশেষ আকর্ষণ এর স্বাদ ও গন্ধ। আর এই ভিন্ন ধারার স্বাদ ও গন্ধের জন্য তাদের বাবুর্চিরা নিজেরাই কয়েক পদের বিশেষ মশলা তৈরি করেন, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

হকের হালিম:
বেইলি রোডের ইফতার বাজারে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়বে শান্তিনগর মোড়ে হকের হালিমের দোকান। একটি দোকানকে ঘিরে প্রায় হাফ ডজনেরও বেশি বিক্রেতা হাঁড়ির ঢাকনা বাজিয়ে হাঁকডাক দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে তারা সুর করে বলতে থাকেন, ‘বাসায় নিয়া যান, মজা কইরা খান।’ এখানের হালিম হাঁড়ির আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকায়।

মুসলিম হালিম:
এই হালিমের স্বাদ নিতে হলে যেতে হবে বিজয়নগর মুসলিম মিষ্টি ঘরে। তারাও বিশেষ পদের মশলা দিয়ে তৈরি করে থাকেন এই হালিম। প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুসলিম হালিম তৈরিতে সৌদি জিরা, কাঁচামরিচ, শুকনা মরিচ, তেজপাতা, জইন, বড় ও ছোট আকারের বাদাম, পেস্তা বাদাম, সাদা ও কালো গোলমরিচ, শাহি জিরা, সাদা সরিষা, কালো সরিষা, দুধ, মাওয়া, জায়ফল, জ্যাতিরিক, দারুচিনি, ছোট ও বড় এলাচ, আলু বোখারা, কিশমিশ, জাফরান, সৌদি আদা, বচ, কাবাবচিনি, মেথি, কালোজিরা, ঘি-ডালডা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, হলুদ, ধনেগুঁড়া, তেঁতুল, লবণ, সয়াবিন তেল, পাঁচফোড়ন, সাত প্রকারের ডাল, গম, চালের গুঁড়া প্রভৃতি উপকরণে ব্যবহার করা হয়।

মামা হালিম:
ঢাকার প্রায় সব হোটেলে হালিম পাওয়া গেলেও ‘মামা হালিমে’র সুনাম আজ শহরময়। নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোজনরসিকরা এসে স্বাদ নেন এ হালিমের। পাকিস্তান আমলে কুমিল্লার লাকসাম থেকে ঢাকা আসেন দ্বীন মোহাম্মদ মনু। তিনিই মামা হালিমের রূপকার। তিনি হালিম তৈরির পদ্ধতি শিখেছিলেন বিহারি নামে পরিচিত এক পাকিস্তানি নাগরিকের কাছ থেকে। সেই আমল থেকে কলাবাগানে অদ্যাবধি তার তত্ত্বাবধানেই চলছে মামা হালিম তৈরির কাজ।

মামা হালিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয় শত প্রকারের মসলা। কিন্তু এর মধ্যে সাত প্রকারের মসলার নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন মোহাম্মদ মনু।

হালিম তৈরিতে কী ধরনের মশলা ব্যবহার হয় জানতে চাইলে মামা তা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি মারা যাওয়ার আগে দুই সন্তানের যে রাজি হবে তাকে শিখিয়ে যাব। এছাড়া আর অন্য কাউকে এই ফরমূলা বলা যাবে না।’

রাজধানীর কলাবাগান, জিগাতলা ও পান্থপথে তাদের শাখা আছে । বেলা ৩টা থেকে বিক্রি শুরু হয়। রোজার দিনে ইফতারের পর অন্য সময়ে বিকাল থেকেই কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে মামা হালিমের দোকানে দেখা যায় ক্রেতাদের লম্বা লাইন।

এছাড়াও তেজগাঁও, ধানমণ্ডি, মিরপুর, তালতলা, রামপুরা, হাজারিবাগ, চৌধুরী পাড়া, পান্থপথ, মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকায় পাওয়া যায় ঢাকাইয়া হালিম। তাছাড়াও হোটেল-রেস্টুরেন্টেও দেদারছে হালিম বিক্রি হচ্ছে।

পাঁচ তারকা হোটেল:
পাঁচ তারকা হোটেলগুলোও এখন পিছিয়ে নেই এই হালিম তৈরির প্রতিযোগিতা থেকে। রূপসী বাংলা, সোনারগাঁও, ওয়েস্টিন, রিজেন্সি, র‌্যাডিসনেও যেমন হালিম পাওয়া যায়, তেমনি গুলশানের বিএফসি, এরিস্টোক্র্যাট, ইফিস, এঅ্যান্ডবির মতো অভিজাত রেস্টুরেন্টেও এখন হালিম পাওয়া যায়। এসব হোটেলে ৫৫০-১০০০ টাকার মধ্যে হালিম পাওয়া যায়।

ইদানিং, হোটেল-রেস্তোরাঁয় তৈরি হালিমের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি প্যাকেট হালিম পাওয়া যাচ্ছে। তবে তাতে সেই স্বাদ ও ঐতিহ্যের কিছুটা ঘাটতি থাকায় তা খুব একটা মন যোগাতে পারেনি ভোজনরসিকদের। তবে অভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি এখন ফুটপাতেও হালিম পাওয়া যায়। যে কেউ রাস্তার পাশের দোকান থেকে হালিম খেতে পারেন। ১০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যেই হালিম পাওয়া যায়। সমাজের শিক্ষিত মানুষ, পথচারি, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, ক্রিকেটার, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পীসহ অনেক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মানুষ এ হালিমের নিয়মিত ক্রেতা।

প্রসঙ্গত, নবাবি আমলে পুরান ঢাকার অভিজাত, সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে হালিম একটি জনপ্রিয় খাবার ছিল। তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। কারও কারও মতে মোগল আমলে গৃহকর্মী ও নিম্নশ্রেণীর লোকজনের জন্য সহজে রান্নার উপাদান হিসেবে হালিম তৈরি হতো। তৎকালীন বাবুর্চিদের কষ্ট লাঘব করার জন্য ডাল, মাংস, গম ও চালের গুঁড়া একত্রে পানিতে মিশিয়ে জাল দিয়ে সিদ্ধ ও গাঢ় করে সালাদ মিশিয়ে পরিবেশন করা হতো। এভাবেই হালিমের উৎপত্তি। হালিম ক্রমেই ধনীদের খাবারের তালিকায় যুক্ত হয়।



মন্তব্য চালু নেই