রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কুঠিবাড়ি

বাংলা সাহিত্যের উৎসভুমি হিসাবে নওগাঁ জেলার পতিসর একটি অনন্য নাম। বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে পতিসরের স্মৃতি। জমিদারির দায়িত্বগ্রহনের পর ১৮৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে কালীগ্রাম পরগনাভুক্ত পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রথম আগমন ঘটে। এই অবহেলিত জনপদের লোকজীবনের কল্যানে রবীন্দ্রনাথ এখানে এক অনন্য কর্মযজ্ঞের সূচনা করেন। প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষিব্যাংক, স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য চিকিৎসালয়, শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন এবং সামাজিক শৃংখলা রক্ষার জন্য তিনি শালিসি ব্যবস্থার প্রচলন করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ দু:স্থ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পতিসরে পল্লী সংগঠনের কাজ শুরু করেন।পল্লী সংগঠন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় একটি সাধারণ সভা। উল্লেখ্য যে, ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষের প্রচলন করে কবি রবীন্দ্রনাথ প্রতিসরে সোনাতন কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকতার সূত্রপাত করেন।

এই ছায়াস্নিগ্ধ নিভৃত পল্লীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে সাথে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন বাংলার সাহিত্যের কিছু অবিশ্বরণীয় গল্প, কবিতা , নাটক ও গান।পতিসরে বসে তিনি রচনা করেছেন কাব্য নাটিকা ‘বিদাং অভিসাপ’, ‘গোঁরা’, ও ‘ঘরে বাইরে’। উপন্যাসের অংশবিশেষ। রচনা করেছেন ছোট গল্প ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’। প্রবন্ধ ‘ইংরাজ’ ও ‘ভারতবাসী’। এছাড়াও চৈতালী কাব্যের অধিকাংশ কবিতা , চিত্রা কাব্যের শেষ পর্বের কবিতা ‘পূর্নিমা ও সন্ধ্যা’ এবং শিশুতোষ কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’ ও ‘তালগাছ’ তিনি রচনা করেছিলেন এই নওগাঁর পতিসরে বসেই। পতিসরে রচিত গানের মধ্যে রয়েছে ‘তুমি নব নব রুপে এলো প্রাণে’ ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ ‘তুমি আমার নিভৃত সাধনা’ ‘বধূ মিছে রাগ করোনা’‘আমি কান পেতে রই’সহ আরো অনেক গান।
১৯৩১-৩২ সালে নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক অন্নদা শংকের রায় প্রসঙ্গে টেনে বলেছিলেন- হাতী ছিল আমার প্রধান বাহন। যেমন হাউস বোট ছিল আমার প্রধান যান, পাই কোথায়? জমিদারের কাছে। নওগাঁর মহকুমায় তখন মোটর চলাচল যোগ্য রাস্তা নেই,পায়ে হাঁটাও যায়না। কারণ হলো কাঁদায় কোমড় পর্যন্ত ডুবে যায়, সেখানে হাতির মতো সহায় আর কে আছে। সেই হাতিও একবার তলিয়ে যাচ্ছিল আমাকে নিয়ে। তবে হাতিতে চড়ে তো স্বপরিবারে যাওয়া যায়না। যেতে হয় পালকিতে চড়ে। রবীন্দ্রনাথের মতো, উনি কেমন করে যে পারলেন, আমিতো হাত-পা গুটিয়ে বসে হাঁপিয়ে উঠি। হ্যাঁ, আমার ভাগ্যে লিখা ছিল রবীন্দ্রনাথের পালকিতে চড়া , আর হাউস বোটে চড়ে বেড়ানো , তবে পালকিটা পতিসরের নয়, শিলাইদাহ, দুই যায়গাতেই আমাকে যেতে হয়েছে। কখনো নওগাঁ থেকে কখনো কুষ্টিয়া থেকে। আক্ষরিক অর্থে তাঁর পদাংক অনুসরণ করেছি। রাজশাহী জেলা ম্যাজিট্্েরট হয়ে কালীগ্রামেও গিয়েছি। এতে করেও তাঁ প্রেরণায় শতাংশের এক একাংশও পাইনি। প্রশাসন আমাকে রাহুর মতো গ্রাস করেছিল। যুগটা ছিল সত্যগ্রহের তথা সন্ত্রাস বাদের যুগ। আমাকে পাল্লা দিয়ে জনসংযোগ করতে হচ্ছিল। ঠাকুর বাবুরা কদাচিৎ আসেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে মাত্র একটিবার আসতে দেখেছি। আত্রাই ঘাটে প্রজাপরিবৃত্ত। শেষ বিদায় নিচ্ছেন। তখন আমি রাজশাহীতে জেলা ম্যাজিট্্েরট। আমার কাছে জমিদার হিসাবে তাঁর একটি গোপনীয় আর্জি ছিল। (সূত্র যুক্তবংগের স্মৃতি পৃষ্ট ১২ ও ১৩)।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বংগাব্ধের ৯ ফাল্গুনের সন্ধ্যাকে কেন্দ্র করে পতিসরে রচনা করেছেন “ সন্ধ্যা ” কবিতা। ক্ষান্ত হও, ধীরে কথা কও, ওরে মন, নত কর শির, দিবা হ‘ল সমাপন, সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী, তিমিরের তীরে অসংখ্য প্রদীব, জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে এলো আরতির বেলা।
কবি তার আপন সৌন্দর্য্য সাধনার পবিত্রকে উপরব্ধি করেছিলেন তাকে নানাভাবে, নানাবর্ণে, গন্ধে-ছন্দে, নিত্য নব নব ক্যায়ায়-মায়ায় সাজিয়ে পতিসরে দর্শন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের, আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদেন সাংস্কৃতির সেই অনতিক্রমা গৌরব যিনি সম্পুর্ণ একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের জগতে এমন একটি বিপ্লব ঘটিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত সমগ্র পৃথিবীতে বিরল। মহাকালের অমোঘ বিবর্তনে যুগে যুগে আমাদের স্বীয় সাংস্কৃতির কর্মব্যাপকতায় । আমাদের সুদিনে-দুর্দিনে , আনন্দে-বেদনায়, হতাশায়-উচ্ছাসে নানান পটভূমিতে রবীন্দ্র প্রতিভা তার বর্ণালী দ্যুতি ছড়িয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায় , উপলব্ধি করে। মনে পড়ে যায় এলাহাবাদে রচিত কবির সেই কবিতার কথা।“ ভেংগেছে দুয়ার এসেছে য্যের্তিময় জয় হে তোমার জয়-তিমিরা বিদায় উদার অভ্যুদ্বয়, জয় হে তোমার জয়”। রবীন্দ্রনাথের কল্প জগৎ , মনীষার বৈচিত্র- বৈচিত্র ও মননের দিগন্তের যতটুকু আমাদের আকৃষ্ট করে তার পুরোটাইসামাজিক ভাবনাকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের রচনার ভান্ডার বিশাল।এই সুবর্ণ ভান্ডারের তিনটি মনিকা “ শান্তি” “ ঠাকুরদা” ও “প্রতিহিংসা” পতিসরে রচিত মর্মে গবেষকরা অদ্যাবধি নিশ্চিৎ হয়েছেন।ঘটনা বিন্যাস ও শিল্প শৈলীর প্রেক্ষাপটে তিনটি গল্পেই রয়েছে গভীর মানবিকতাবোধ ও সমাজ পরিবর্তনের অসংখ্য উপাদান। বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের যে অকৃত্রিম আনন্দধারা উদ্ভাবিতহয় তাই সহজে প্রভাবিত হয়েছে এই নিরলংকৃত সরল গল্পগুলোর মধ্যে। এই আনন্দ বিশ্মিত সৃষ্টির মধ্যে হতভাগ্য জনদরিদ্র পল্লীবাসির জাগরণের দৃষ্টান্ত আমাদের সাহিত্যে আর কোথাও নেই।

বস্তুত রবীন্দ্রনাথ মানব জীবন, মানব সমাজ ও মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে মানবিক সত্যকে সবার উপরে ঠাঁই দিয়েছেন। তাঁর সমাজ চেতনা তাই মানব চেনতা নির্ভর শুধু নয়; তা মানবিক চেতনায় এবং মানবিক প্রয়োজনের উপর নির্ভর। সে প্রয়োজন অবশ্যই মানব কল্যাণের, মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে বাঁধা। প্রকৃতির সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের ভাবনা একই বোধে জড়িত। তিনি তার রচনায় বার বার যে শিথিল চরাচরে ব্যাপ্ত বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়েছেন। সমুদ্রের অবিরাম কলধ্বনির যে ঐক্যতানের সুর তার কানে বাজে সে সুর মানবতার দু’কূলকে প্লাবিত করে ভাসিয়ে নেয় আবহমান কালের পাঠকদের। শুধু পৃথিবী আর সমুদ্রের বন্ধন নয়, বিশ্ব ভুবনের প্রতিটি কণিকার সাথে তিনি অনুভব করেছেন আতœীয়তাবন্ধন। তাই প্রকৃতি,মানুষ ও মানুষের বাসভূমি এই তিনের পরস্পর সমন্বযকে ঘিরেই তার সমাজ ভাবনার বৃত্ত আবৃত্ত হয়। এক কথায় পতিসরকে বাদ দিয়ে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ও প্রজাহিতৈষী রবীন্দ্রনাথকে অন্বেষণ ও অনুধাবন করা সম্ভব নয়।#



মন্তব্য চালু নেই