যে কারনে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী একই নৌকায়
সাগরে ভাসমান প্রায় ১০ হাজার অসহায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের কথা তো সবাই কম বেশী জানেন। একটি নৌকা ডুবে যাওয়াতে, এমন অসহায় ৭০০ জন ইন্দোনেশিয়াতে আশ্রয় পেয়েছে। তাদের মুখে শোনা গেছে ঘটনার ভয়াবহতা। প্রচন্ড খাদ্য অভাবের মধ্যে তাদের ভাসমান নৌকাতে কিছু খাবার পাওয়া গেলে তা নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি হয়েছে যে একে অন্যকে ছুরিকাঘাত করেছে, ফাসিতে ঝুলিয়েছে, সাগরে ফেলে দিয়েছে। ওই খাবার নিয়ে মারামারিতেই ১০০ লোক প্রান হারিয়েছে। ঘটনার ভয়াবহতা চিন্তা করলে ভয়ে শরীর কাপে। এই অসহায় লোকদেরকে আল্লাহ একটা গতি করে দিন, এই দোয়া করি। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।
এই রোহিঙ্গাদের সাথে একই নৌকায় ভাসছে হাজারো বাংলাদেশের নাগরিক। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, ভাসমান লোকদের ভেতরে প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশী। জাতিসঙ্ঘের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারীত ও অসহায় জাতি রোহিঙ্গা। এদের সাথে একই নৌকায় ভেসে বাংলাদেশীরা সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, নিজের জীবন বিপন্ন করছে সেই সাথে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে কলুষিত করছে। এমন একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ বলতে উন্নত বিশ্বে দুঃভিক্ষ, বন্যা , মহামারি ইত্যাদি বুঝত। এর পরে ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে পাট, চিংড়ী, গার্মেন্টস, ক্রিকেট ও সম্প্রতি ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য। সেই বাংলাদেশকে এক ধাক্কায় আবার ওই দুঃর্ভিক্ষের ইমেজে নিয়ে গেল এই একটি ঘটনা। এটা একটা সাধারন বুদ্ধির ব্যাপার। যারা প্রান ভয়ে পালাচ্ছে, তাদের সাথে যে পালায় যে নিশ্চয়ই শখ করে পালায় না। তার নিশ্চয়ই এমন কোন বড় সমস্যা আছে যে জন্য সে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও ওই নৌকায় পাড়ি জমায়। আর এটা মনে করেই বিদেশীরা এখন বাংলাদেশকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। যারা বিদেশে আছেন তারা এই ব্যাপারটি কম বেশি বুঝতে পারছেন।
বিভিন্ন আলোচনাতে, লেখা লেখিতে এ ব্যাপারে আবেগপ্রবন কথা শোনা যায়। শোনা যায়, মানুষের কাজ নেই, সংসার চলে না। শোনা যায় দারিদ্রতার কথা। এই দারিদ্রতার চাপে অসহায় হয়ে মানুষ বেছে নেয় এই অনিশ্চিত ভবিশ্যতের যাত্রা। এসব শুনে আমরা আবেগপ্রবন হয়ে পড়ি। হ্যাঁ, বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশের মানুষ অর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দারিদ্রতা ভর করেছে। হ্যাঁ, এটা একটা কারন। তবে এসবের চেয়ে বড়, অন্য কিছু কারন আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারন হল, অজ্ঞতা। অনেকে হয়ত আমাকে তিরস্কার করতে পারেন এই বলে – “অমন লেকচার দেওয়া সহজ। বাস্তবতা অনেক কঠিন।” হ্যাঁ ভাই, বাস্তবত কঠিন বলেই তো আমি বিদেশের নাম শুনেই অজ্ঞতা বসত, যাচাই না করে ঝাপিয়ে পড়তে নিষেধ করছি।
অজ্ঞতাঃ বৈধ পথে সব দেশে যাওয়ার অনেক উপায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হল ভ্রমন, চিকিৎসা, ছুটি, শিক্ষা, কর্ম ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার যদি যথাযত কারন ও যোগ্যতা থাকে তাহলে মঙ্গল গ্রহের ভিসাও কোন সমস্যা নয়। আপনি আমেরিকাতে ভ্রমন করতে যাবেন। ভালো কথা। অন্য কয়েকটি দেশ ভ্রমন করুন। প্রথমেই আমেরিকা ভ্রমন করবেন এই কথাটা কেউ বিশ্বাস করবে না, ভিসা দিবে কিভাবে? আপনি কানাডাতে লেখা পড়া করতে যাবেন। সেই পরিমান টাকা আপনার আছে? আপনি কি ওই কোর্সে পড়ার জন্য যোগ্য? তাহলে হাসতে হাসতে ভিসা নিয়ে আসুন। আপনি অমুক দেশে চাকুরী করবেন। সেই কোম্পানী কি আপনাকে চাকুরী নিশ্চিত করেছে? তাহলে ভিসা সমস্যা হবার কথা নয়। সল্প মেয়াদী ভিসা ফী ৪০ হাজার টাকার বেশী নেই বিশ্বের কোন দেশে। দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত বিমানে যেতে দুই লাখ টাকার বেশী লাগে না। তাহলে দুবাই ৮ লাখ, ইটালীতে যেতে ১৪ লাখ, মালয়েশিয়াতে যেতে ১২ লাখ এমন খরচ কেন? কারন দুটি – এক, অযোগ্য লোককে যোগ্য বানানো হয়। দুই, অবৈধ পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অবৈধ পথে নেওয়াটা দালালের জন্য আর্থিক লাভ বেশী। তারা তাদের সীমানা পার করে অন্য দালালের হাতে তুলে দেয়। ওরা ওদেরকে গন্তব্যে পৌছে দেয় নাকি মেরে ফেলে তাতে কারো কিছু যায় আসে না। আমি দুটি বিষয়ে শত ভাগ নিশ্চিত। এক, যারা এভাবে লাখ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেস্টা করে তাদের একটা অংশ চেস্টা করলে নিজেই বিদেশে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে ও চার ভাগের এক ভাগ খরচে নিজেই বিদেশে যেতে পারবে। দুই, কি ভোগান্তি বা বিপদের মুখে তারা পড়তে যাচ্ছে সেটা যদি যানত, তবে কেউই লাখ লাখ টাকা দিয়ে ওই বিপদ কিনত না। তারা বলত, আমি মরতে চাই না, এর চেয়ে দেশে লাঙ্গল চাষ করে বা রিকশা চালিয়ে বাচব।
টাকার জোগানঃ বাংলাদেশে হতদরিদ্র পরিবার, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তারাও কিভাবে জানি বিদেশে যাওয়ার কথা শুনলে কয়েক লাখ টাকা যোগাড় করতে পারে। জমি জমা ইত্যাদি বিক্রি করে টাকা যোগাড় করে। যাদের জমি নেই তাদের রয়েছে উচ্চ সুদে টাকা নেওয়ার ব্যাবস্থা। এমনভাবে হটাত করে টাকা দেওয়ার মতন সাহস শুধু বাংলাদেশীদেরই আছে। এমনভাবে ঝুঁকি নিয়ে আর কোন জাতি টাকা দেয় না। এজন্য অজ্ঞতাও কিছুটা দায়ী। যে টাকা খরচ করে তারা বিদেশে যাচ্ছে সেই টাকা কত বছরে আয় করতে পারবে সেই চিন্তা করেনা। করলেও ভুল হিসাব করে। যার ফলে বৈধ পথে গিয়েও হায় হায় করে। কারন প্রয়োজনের চেয়ে ৪-৫ গুন বেশী টাকা খরচ করে এসেছে। আর অবৈধ পথে গেলে তো কথাই নেই। একে তো প্রান বিপন্ন হবার আশংকা। ভাগ্যগুণে প্রানে বেঁচে গেলেও সেই দেশ থেকে বের করে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সৌভাগ্যবান হলে সেই দেশে কয়েক বছর থেকে যেতে পারে। কিন্তু যে টাকা আয় করে তার বেশীরভাগই দিতে হয় সেই আইনজীবিকে যে তাঁকে আইনের ফাক ফোঁকর দিয়ে সেই দেশে ৪-৫ বছর রেখে দিতে পারবে। পথের টাকা পথেই শেষ। এখানেও অজ্ঞতা আছে আমাদের মাঝে। বিদেশে যাবার কথা শুনলে, ধার করে হলেও, লাখ টাকা বের করে দেবার এমন ক্ষমতা শুধু বাংলাদেশীদেরই আছে। এজন্য ধরা খায়ও তারা বেশী।
অতিরিক্ত আত্ম-বিশ্বাসঃ একে আত্ম-বিশ্বাস বলে নাকি দুঃসাহস বলে, সেটা আমি জানিনা। তবে এমন সাহস কেবলমাত্র বাংলাদেশীদেরই আছে। তারা মনে করে বিদেশের মাটিতে পা দিলেই চলবে, এর পরে বাকীটা সে নিজেই করে নিতে পারবে। এমনও দেখা গেছে – দালাল তাকে বলছে, “আপনার জন্য গন্তব্য দেশে পৌছানোর পরে অস্থায়ী থাকার ব্যাবস্থা করা হবে”। সেই কথা শুনে অতি উতসাহী বিদেশ যাত্রী বলছেন – “আরে এসব লাগবে না, আমাকে শুধু ওই দেশে ফেলতে পারলেই হবে। আমি নিজেই সব করে নিব।” অনেকে আবার এও বলে – “আটার বস্তার মতন ফেলতে পারলেই হবে।” এটাও এক ধরনের অজ্ঞতা। জাপান, কোরিয়া এসব দেশের লোকেরাই ইউরোপ আমেরিকা যাবার আগে দশবার চিন্তা করে। নতুন দেশ, ভিন্ন ভাষা, অচেনা যায়গা, কিভাবে কি করবে এই ব্যাপারে দুঃচিন্তা থাকে। ওদিকে আমাদের বাঙ্গালী, বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকায় যাবার অভিজ্ঞতা থাকলেই নিজেকে বেশ এক্সপার্ট মনে করে। আর এভাবেই দালালের কাছে টাকা দেয়। দালালও তাঁকে আটার বস্তার মতনই ফেলে দেয়। লোকটি তখন মজা বুঝতে পারে।
লোভঃ প্রবাসী বাংলাদেশীদের সবাই শ্রমিক নয়। অনেক মেধাবী ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোক আছেন যারা বেশ বড় পদে বহাল থেকে দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। এমন বড় মাপের লোকদের চাল চলন খুবই সাধারন। দেখলে বোঝাই যায় না যে তিনি অত ভাল একটা অবস্থানে আছেন। ওদিকে যারা কামলা (শ্রমিক) তাদের ফুটানির অভাব নাই। (সবাই এমন নয়, ব্যাতিক্রমও আছে)। দেশে যখন বেড়াতে আসে তখন গলায় সামনে তো টাই ঝুলায়, পারলে পেছনেও আরেকটা টাই ঝুলায়। দু হাতে টাকা খরচ করে। এটা দেখে দেশের তরুন ও যুবকের হিংসায় গা জ্বালে। মনে করে, লোকটি না জানি কত ধনী। এই সহজ জিনিসটা বোঝে না যে , দেশের একজন শ্রমিক ঢাকা থেকে বরিশালে ঈদে বেড়াতে গেলে অন্তত ৫-৭ হাজার টাকা নিয়ে যায়। প্রবাসী শ্রমিক লোকটিও তেমনি ৫-৭ হাজার ডলার নিয়ে বেড়াতে এসেছে। থাকবে সর্বোচ্চ এক মাস। এই এক মাসে ৫ হাজার ডলার খরচ করতে হলে প্রতিদিন বাংলাদেশী টাকায় অন্তত ১২ হাজার টাকা খরচ করতে হবে। একজন লোক প্রতিদিন ১২ হাজার টাকা খরচ করছে দেখে এলাকার লোকজনের মাথা খারাপ হয়ে যায়। অথচ লোকটি কিন্তু বিদেশে এমন খরচ করার সামর্থ হয় না। বেড়ানো শেষে বিদেশে ফিরেও যাবে প্রায় শুন্য হাতে। ওখানে গিয়ে আবার কাজ শুরু হবে, আবার শুরু হবে টাকা জমানো। আর এই টাকা জমাতে গেলে কিভাবে প্রতিনিয়ত নিজের ছোট খাটো শখ-আহলাদ জলাঞ্জলি দিতে হয় সেটা একমাত্র প্রবাসীরাই জানেন। বিদেশে টাকার গাছ আছে এবং ঝাড়া দিলেই টাকা পড়ে – এমন একটা ইমেজ প্রবাসীরাই বানিয়ে রেখেছে। এটা দেখেই দেশের মানুষ লোভ করে। সেই লোভে পড়েই টাকা আর জীবন দুটোরই ঝুকি নেয়।
এত কিছুর সাথে আরেকটি ছোট কারন আমাদের ভেতরে আছে। আমাদের দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। দেশপ্রেম কাকে বলে সেটা আমরা ভালোভাবে বুঝি না। ৭-৮ বছর আগে অস্ট্রেলীয়ার মেলবোর্নে কিছু ভারতীয় ছাত্রদেরকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল ওই দেশের স্থানীয় ছেলেরা। এই নিয়ে বেশ হই চই হয়েছিল। সেই বছর ভারত থেকে যে সব ছাত্ররা ভিসা পেয়েছিল তার ৮০% ই অস্ট্রেলীয়াতে যায় নি। ওদের কথা ছিল, যে দেশে আমার দেশের লোককে মারা হয়, সেই দেশে আমরা কেন যাব? এই জিনিসটাকেই দেশপ্রেম বলে। বিদেশী ছাত্ররা অস্ট্রেলীয়ার সরকারের আয়ের বেশ বড় একটি উৎস। তাই ব্যাবসা টেকাতেই, পরের বছর অস্ট্রেলীয়ার পররাস্ট্র মন্ত্রী ভারতে এসে কয়েকটি শহরে সেমিনার করে বক্তৃতা দিয়ে বলে গেছে -” তোমরা আমাদের দেশে এস, আমরা কোন রকমের সন্ত্রাস হতে দিব না”। ওদিকে আমাদের দেশে পত্রিকা খুললে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের কিছু প্রবাসীদের দুরাবস্থা। পত্রিকায় দেখা যায় কিভাবে নারী শ্রমিকদেরকে মধ্যপ্রাচ্যে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। বেঁচে ফিরে এসে মর্মান্তিক ঘটনার বর্ননাও দিয়েছেন অনেকে। এর পরেও মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার এমন সুযোগ পেলেই খোঁজ না নিয়েই, নারী-পুরূষ সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। উচ্চ সুদে টাকা ধার করে হলেও। যারা বিদেশে আছেন তাদের অনেকেই এই কথাটি স্বীকার করেন যে, বিদেশে আসতে যে টাকা খরচ করেন এবং তারা যে পরিশ্রম তারা করেন সেই খরচ ও পরিশ্রম দেশে করতে পারলে তাকে বিদেশে আসতে হোত না।
যাই হোক, দোয়া করি আমাদের দেশের রাজনীতি , অর্থনীত ইত্যাদি এমন অবস্থা হোক যেন কাউকে জীবনের ঝুকে নিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হতে না হয়। আশা করি, সম্প্রতি আলোচিত এই ভাসমান রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের দুরাবস্থা দেখে সবাই শিক্ষা নিবে। সঠিক তথ্য, বৈধ কাজগপত্র ও উপযুক্ত কাজ ছাড়া কেউ যেন বিদেশে যাবার চেস্টা না করে। আরো আশা করি, অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়াটা যেন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
এস এম এলিট
ব্লগার ও মুক্ত লেখক
মন্তব্য চালু নেই