যে কারণে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহতদের ছবি প্রকাশ হচ্ছে না
হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের অভিযানে নিহতদের ছবি প্রকাশ করে তাদের বিষয়ে তথ্য চাইলেও ইদানীং আর ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে না। যদিও এর আগের ছবি প্রকাশের সুফল মিলেছিল। বেশিরভাগ সন্দেহভাজন জঙ্গির পরিচয় প্রকাশ হয়েছিল তাদের স্বজনদের সূত্রেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহতদের ছবি প্রকাশ করে তাদের বিষয়ে তথ্য চাইছে না পুলিশ। আবার নিহতদের পরিচয় শনাক্তেও হিমশিম খাচ্ছে তারা।
গত বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের নাসিরপুর আস্তানার সাত থেকে আট জন, ২৭ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী আস্তানায় আতিয়া মহলে নিহত চার জনের, গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকু- আস্তানায় নিহত পাঁচ জনের মধ্যে দুই জনের, পরদিন রাজধানীর আশকোনায় র্যাবের নির্মাণাধীন সদরদপ্তরে ‘আত্মঘাতী’ যুবক, তারও পরদিন খিলগাঁওয়ে র্যাবের তল্লাশি চৌকিতে ‘আত্মঘাতী’ হামলা চেষ্টার সময় গুলিতে নিহত যুবক-কারও পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
২৪ মার্চ বিমানবন্দর মোড়ে বিস্ফোরণে নিহত যুবককে তার স্বজনরা শনাক্ত করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। তার নাম আয়াদ হোসেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশও।
আয়াদের স্বজনরা পুলিশকে জানান, খালাতো ভাই রাফিদ হাসানের সঙ্গে আয়াদ গত বছরের ৯ আগস্ট বাসা ছাড়েন। বাড়ি ছাড়ার আগে তারা বাড়িতে একটি চিঠি লিখে যান যাতে লেখা ছিল তারা সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছেন।
পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারলেও কেন সন্দেহভাজন জঙ্গিদের ছবি প্রকাশ হচ্ছে না-জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, আসলে তারা ছবি প্রকাশ করতে পারছেন না। এর কারণ কী জানতে চাইলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সন্দেহভাজন জঙ্গিরা এখন যতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে, এর আগে তারা ততটা ছিল না। যখন তারা ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারছে, তখন তারা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এতে দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এগুলো ছবি প্রকাশ করা যায় না।
সাম্প্রতিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সিলেটের আতিয়া মহলের অভিযান। এই অভিযানে নিহত চারজনের মধ্যে অন্তত দুইজন আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজের দেহ উড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। নিহত চার জনের মধ্যে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি নেতা মুসা বলে ধারণা করছে পুলিশ। যদিও এ বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেনি বাহিনীটি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরদিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গিসহ ছয় জনের ছবি প্রকাশ করা হয়। এর পরই পাঁচজনকে শনাক্ত করে তাদের স্বজনরা।
একই বছরের ২৮ জুলাই মিরপুরের কল্যাণপুর আস্তানায় নিহত নয় জনের ছবি প্রকাশের পর অন্তত ছয় জনকে শনাক্ত করেন তাদের স্বজনরা। বাকিদের মধ্যে দুই জনকে শনাক্ত করা হয় তাদের আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে। আর একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
এরপর নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, প্রশিক্ষক হিসেবে চিহ্নিত জাহিদুল ইসলামের পরিচয়ও প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে তাদের ছবি আসার সঙ্গে সঙ্গে।
তাহলে এখন কেন ছবি প্রকাশ করছেন না-জানতে চাইলে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেসব লাশের ছবি প্রকাশ করার মত সেইসব লাশের ছবিই প্রকাশ করা হয়েছে। কোন বিকৃত লাশের ছবি প্রকাশ করা যায় না।’
পুলিশ বলছে, ইদানীং সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। যারা পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে তারা সুইসাইডাল ভেস্ট পড়ে থাকে এবং যখন তারা বুঝতে পারে ধরা পড়ে যাবে, তখনই তারা সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটায়।
সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটলে কী হয়, তার একটি নমুনা দেখা গেছে গত ১৭ মার্চ আশকোনার ঘটনায়। র্যাবের নির্মাণাধীন সদরদপ্তরের ভেতরে নিহত যুবকের এমন একটি ছবি পাওয়া গেছে যা কোনোভাবেই প্রকাশযোগ্য নয়। তার শরীরের গলা থেকে পা পর্যন্ত মাংস সব উড়ে গিয়ে পড়েছে আশেপাশের এলাকায়। মুখম-লটিই কেবল অক্ষত রয়েছে। এই মুখম-লের ছবি গণমাধ্যম প্রকাশ করলেও বাকি অংশ বেশ কায়দা করে মুখে দিতে হয়েছে।
পুলিশ বলছে, চট্টগ্রামের সীতাকু-, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এবং সবশেষ মৌলভীবাজারের বড়হাটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে ভেতরে যে ছবি দেখা গেছে সেটি বীভৎস।
এর মধ্যে মৌলভীবাজারের নাসিরপুর আস্তানায় কয়জন নিহত হয়েছে, সেটিই নিশ্চিত নয় পুলিশ। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেখানে সাত থেকে আটজন নিহত হয়েছেন বলে তাদের ধারণা। তিনি জানান, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহের টুকরোগুলো দেখে তারা এই ধারণায় পৌঁছেছেন। সেগুলো জোড়া দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে নিহতের সংখ্যা আসলে কতজন।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘ছবি প্রকাশ করলেই যে পরিচয় শনাক্ত করা যায় সেটা ঠিক নয়। অনেকের ছবি প্রকাশ করেও পরিচয় জানা যায়নি। পরিচয় জানতে আরও নানা প্রক্রিয়া আছে। যেমন নির্বাচন কমিশনে জমা থাকা আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, ডিএনএ সংগ্রহ প্রভৃতি।
সীতাকুণ্ড আস্তানায় নিহত পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনের পরিচয় এভাবেই শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আর সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় নিহতদেও মধ্যে জঙ্গি নেতা মুসা আছেন কি না, তা নিশ্চিত হতে তার স্বজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএর নমুনা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মন্তব্য চালু নেই