যেভাবে খুন করা হয় ব্লগার রাজীবকে

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে নিজ বাসার সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে।

এ ঘটনায় নিহতের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে পল্লবী থানায় এ মামলা করেন। মামলার তদন্তে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে উঠে আসে।

২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান শায়খুল হাদীস মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ আটজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯/৩৪ ধারায় অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানি, ঢাকার খিলক্ষেত চৌধুরীপাড়ার মো. ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার পোড়াপাড়া গ্রামের মো. এহসানুর রেজা রুম্মান (২৩), ঢাকার কেরানিগঞ্জ থানার ধলেশ্বর গ্রামের মাকসুদুল হাসান অনিক (২৩), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কলেজপাড়ার মো. নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ (১৯), চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া গ্রামের নাফিজ ইমতিয়াজ (২২), ঢাকার কলাবাগান থানার ভুতের গলির সাদমান ইয়াছির মাহমুদ (২০) ও ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার জয়লস্করের রেদোয়ানুল আজাদ রানা (৩০)।

আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজকক্ষে নামাজ পড়তে গিয়ে আসামিরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হয়। সেই সময় বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রেদোয়ানুল আজাদ রানা তাদের জানায় জনৈক ব্লগার ‘থাবা বাবা’ ইসলাম ও মহানবীর (স.) নামে বাজে কথা লিখছে। তাকে হত্যা করতে হবে। না হলে ইসলাম ও ঈমান রক্ষা করা যাবে না। এভাবেই রানা তাদের রাজীবকে হত্যার জন্য উদ্বুব্ধ করে।

সেই মোতাবেক থাবা বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা। রাজীবকে হত্যার জন্য তারা দু’টি গ্রুপ তৈরি করে। একটি ‘ইনটেল’ গ্রুপ ও অন্যটি ‘এক্সিকিউশন’ গ্রুপ। দুই গ্রুপে ৩ জন করে ৬ জন সদস্য ছিল।

ইনটেল গ্রুপ রাজীবের ব্লগে ও ফেসবুকে ঢুকে ‘থাবা বাবা’ ব্লগ থেকে তার ছবি সংগ্রহ করে। এরপর একদিন ‘ইনটেল গ্রুপ’ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে রাজীবকে শনাক্ত করে আসে। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা রাজীবকে রেকি করা শুরু করে।

ওইদিন ইনটেল গ্রুপের দুই সদস্য রাজীবের সঙ্গে বাসে উঠে। একজন সাইকেলযোগে বাসে রাজীবকে অনুসরণ করে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত গিয়ে তার বাসা চিনে আসে। বাসা চিহ্নিত করার পর ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে নিয়মিত রেকি করা শুরু করে। এ সময় তারা রাজীবকে হত্যার জন্য ঢাকার নর্দ্দা থেকে চাপাতি-ছুরি ও নতুন মোবাইলের সিম ও সেট কিনে।

ঘটনার দিন এক্সিকিউশন গ্রুপের সদস্যরা বিকেল ৪টার দিকে পল্লবীর পলাশনগরে রাজীবদের বাসার গলিতে অবস্থান নেয়। স্কুল ব্যাগ, ক্রিকেটের ব্যাট ও বল ইত্যাদি সঙ্গে রাখে। ইচ্ছাকৃতভাবে ক্রিকেট খেলার নামে তারা বল রাজীবদের বাসায় ফেলে দেয়। পরে বল আনার নাম করে পুনরায় নিশ্চিত হয় সেটি রাজীবের বাসা কি না।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে পৌনে ৮টার দিকে রাজীব যখন পল্লবীর বাসার দিকে যাচ্ছিলেন তখন ইনটেল গ্রুপের সদস্যরা তাকে অনুসরণ করে। বাসার গেটের কাছাকাছি পৌঁছার পর এক্সিকিউশন গ্রুপের রানা তাকে রিকশা থেকে ধাক্কা দেয়। ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপু চাপাতি দিয়ে গলা থেকে মাথা আলাদা করার জন্য কোপ দেয়।

কোপে রাজীব মারাত্মক আহত হয়ে চিৎকার করে দেয়ালের ওপর পড়ে যান। তারপর ফয়সাল রাজীবকে চাপাতি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। আসামি অনিকও তার হাতে থাকা ছোরা দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। ওই সময় কেউ একজন খুন খুন বলে চিৎকার করে এগিয়ে আসতে দেখে তারা পালিয়ে যায়।

রাজীবকে হত্যা করার সময় আসামি দীপের এলোপাথাড়ি কোপের একটি কোপ অনিকের পায়ে লাগে। এতে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের কিছু অংশ কেটে যায়। তাই যাওয়ার সময় অনিক রুম্মানের সঙ্গে কাকরাইল এলাকায় জুতাজোড়া খুলে জাতীয় চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের পুকুরপাড়ে ফেলে যায়।

হত্যাকাণ্ডের দুই বছর সাড়ে নয় মাসের মাথায় এই মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বাকি ৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে এ রায় দেন ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ। এর মধ্য দিয়ে দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্লগার ও লেখক-প্রকাশকসহ মুক্তমনা মানুষের ওপর হামলা-হত্যার প্রথম রায় এলো।



মন্তব্য চালু নেই