অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার কথা

যুদ্ধাহত আব্দুল মাজেদের বীরত্বগাঁথা অজানাই রয়ে গেছে এ প্রজন্মের কাছে

সাতক্ষীরার কলারোয়া মুক্ত দিবসের মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বিজয় মিছিলে দেখা গেলো বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তির হাতে আমাদের অহংকারের প্রতীক জাতীয় পতাকা। এটি শোভা পাচ্ছে তার কাঁধে। দেখে কৌতূহল নিবৃত্ত করার নয়। মিছিল শেষে কথা হয় ওই বয়োবৃদ্ধের সাথে। একান্ত আলাপচারিতায় পরিচয় পর্ব শুরু হলে জানা গেলো তিনি একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। বয়োবৃদ্ধের নাম আব্দুল মাজেদ(৭০)। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তিনি বর্ণনা করছিলেন তার যৌবনের দুরন্ত দিনগুলোর যুদ্ধকালীন নানা স্মৃতির কথা। আব্দুল মাজেদের বাড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী বাকশা গ্রামে। বাবার নাম মরহুম বাখের আলি গাজী। কথা বলে জানা গেলো, একাত্তরের এপ্রিলে আব্দুল মাজেদ একদিন দুপুরে পুকুরে গোসল করছিলেন। এসময় তিনি দেখেন পাকসেনাদের একটি জিপ পুকুরের কোল ঘেঁসে দঁড়াতে। ওই জিপে মাহমুদপুর গ্রামের আফসারকে দেখতে পান তিনি। আফসারকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে পাকসেনারা। আফসারের কাছে সেসময়ের এমএলএ বোয়ালিয়া গ্রামের মমতাজ আহমেদের বাড়ি দেখিয়ে দিতে বলে পাকসেনারা। এরপর জ্বালিয়ে দেয়া হয় মমতাজ সাহেবের বাড়ি। পরে আফসার আলিকে হত্যা করে পাকসেনারা। বাড়িতে মা দুপুরের ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তা আর খাওয়া হয়নি আব্দুল মাজেদের। এদিকের খবর মমতাজ আহমেদকে জানানোর ভারতের হাকিমপুরে ছুটে যান আব্দুল মাজেদ। হাকিমপুরে তখন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প করা হয়। সেময় সেখানে অবস্থান করছিলেন মমতাজ আহমেদ, এন্তাজ আলি, শ্যামাপদ শেঠ, শাহাদাৎ মোড়ল, বিএম নজরুল ইসলাম, মোসলেম উদ্দিন, মোসলেউদ্দিন গাইনসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকবৃন্দ। আব্দুল মাজেদের কাছে নিজ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা শুনে এতটুকু বিচলিত হননি মমতাজ আহমেদ। এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি আব্দুল মাজেদের। মমতাজ আহমেদের সাথে কথা বলে তিনি নাম লেখান মুক্তিযুদ্ধে। হাকিমপুর থেকে তাকে পাঠানো হয় ভারতের টাকিতে। টাকিতে সেময় অবস্থান করছিলেন দেবহাটার মাস্টার শাহাজাহান আলি। টাকি থেকে তাকে পাঠানো হয় ভারতের ঘোজাডাঙ্গায়। এরপর ভোমরা ক্যাম্পে। আব্দুল মাজেদ বলেন, ভোমরায় একাত্তরের ২৯ মে সংঘটিত হয় পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ। প্রায় ১৭ ঘন্টাব্যাপি চলা এই যুদ্ধে তিনি ভোমরা বাঁধের ওপর পাকসেনাদের ছোড়া মুহুর্মুহু গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। পায়ে ও কোমরের পিছন দিকের নিচে তাঁর ৪টি গুলি লাগে। চেতনা হারিয়ে পড়ে যান বাঁধের ওপর। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে নেয়া হয় ভারতের ইটিন্ডির রমেশ বাবুর আমবাগানের শিবিরে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের বদরতলা হাসপাতালে। এরপর সুস্থ হতে তাঁর অনেক দিন লেগে যায়। ভোমরার এই সম্মুখ যুদ্ধে ৭ শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। শহিদ হন ৪ মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন অনেকে। যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন ভোমরা যুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন বলে আব্দুল মাজেদ জানান। এরপর সুস্থ হওয়ার পর তিনি খলিশখালি, ডুগদে, সরুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে গেছেন অপারেশনে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে আব্দুল মাজেদ বলেন, দেশের জন্য লড়াই করতে যুদ্ধে যাই। তাছাড়া বাড়িতে থাকলেও তো পাকসেনাদের হাতে মরতে হবে। তাই মরতে যদি হয়, তা দেশের জন্য মরতে প্রস্তুত ছিলাম। এরূপ মানসিকতা থেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করি। ৯ মাসব্যাপি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ ৬ ডিসেম্বর। যেদিন কলারোয়া পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। স্বাধীন দেশের মাটিতে উড়ানো হয় সবুজের বুকে রক্ত খচিত জাতীয় পতাকা। এই লড়াকু যোদ্ধার কথা এক রকম অজানাই রয়ে গেছে এ প্রজন্মের কাছে। আব্দুল মাজেদের পারিবারিক বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, একটি জীর্ণদশার মাটির ঘরেই তার বসবাস। তার ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে পশ্চিম বোয়ালিয়া প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্বতন্ত্রভাবে থাকেন তাঁর ছেলে। আব্দুল মাজেদের অল্প কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে। ১০ কাঠা জমি বন্ধক দেয়া আছে, তা ছাড়ানো যায়নি। বাকি ১৮ কাঠা জমি লিজ দেন। সেখানে বছরে আসে ৯ হাজার টাকা। আর সরকারি ভাতা পান প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা। এই টাকায় তার বার্ধক্যের এই দিনগুলো এক রকম কেটে যায়। তাঁর সহধর্মিণী অনেক রোগে আক্রান্ত। তার চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া তাঁর নিজেরও প্রতিদিন ওষুধ লাগে। এতোকিছুর পরও ভীষণ তৃপ্ত আব্দুল মাজেদ। কারো কাছে তাঁর যেনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। মানুষের সাথে প্রাণখোলা আলাপ করেই কাটিয়ে দেন তার নিত্য দিনগুলো। ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান বাকি সময়গুলো। আব্দুল মাজেদরা কলারোয়ার মাটিতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন যৌবনের সোনাঝরা দিনে। আর ৪৩ বছর পর কলারোয়ায় গত শনিবার সেই আব্দুল মাজেদ জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে গেলেন একইভাবে। মাঝখানে ৪৩ টি বছর চলে গেলেও এই বয়োবৃদ্ধের হাতে পরম মমতায় সমুন্নত ছিলো জাতীয় পতাকা। ৪৩ বছর আগের আব্দুল মাজেদের চওড়া কাঁধের মতো আজকের আব্দুল মাজেদের কাঁধেও সমান দৃঢ়তায় অটুট রয়েছে জাতীয় পতাকা।



মন্তব্য চালু নেই