‘যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নিলেন সদ্য অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি’
হাইকোর্ট থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আইনজীবী হিসেবে আপিল বিভাগে দাঁড়িয়েছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাবস্থায় সর্বোচ্চ আদালতে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে দাঁড়ানোয় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন এ বিচারপতি। বিষয়টিকে পেশাগত নৈতিকতাবিরোধী বলে দাবি করেছেন আইনজ্ঞরা।
এ অবস্থায় বুধবার আদালতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সাবেক হোক আর সিটিং জজ হোক সবাইকে জাজেস কমপ্লেক্সের মর্যাদা রক্ষা করে চলার জন্য আহবান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধানে বাধা না থাকলেও আমার দৃষ্টিতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা যারা ভোগ করছেন, সরকারি বাড়ি, গাড়ি, গানম্যান ব্যবহার করছেন আবার সরকারের বিরুদ্ধে অর্থাৎ একজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। এটা শোভনীয় নয়। এটা পেশাগত নৈতিকতাবিরোধী।
বুধবার আপিল বিভাগে জামায়াত নেতা মীর কাসেমের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়ান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। আদালতে আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত থাকার বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নজরে আনেন সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এর আগে আপিল বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক নজিরবিহীনভাবে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেন, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়। তার কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাসহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা। এর মধ্যেই হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর অবসরের দুই মাসের মাথায় সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে আপিল বিভাগে দাঁড়ান, যা নৈতিকতাবিরোধী বলে মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, দফায় দফায় বিতর্কিত ঘটনার কারণে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বিচার বিভাগ রক্ষা করার জন্য তারা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান। জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বর অবসরে যান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। বর্তমানে তিনি অবসরোত্তর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এখনও তিনি বিচারপতিদের বাসস্থান ‘জাজেস কমপ্লেক্সে’ বসবাস করছেন। নিয়ম অনুযায়ী তার সরকারি গাড়ি, নিরাপত্তার জন্য গানম্যান, টেলিফোন বিলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। অবসরের পর এক বছর পর্যন্ত তিনি এসব সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন। এ অবস্থায় অবসরে যাওয়ার মাত্র দু’মাসের মাথায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর পক্ষে আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম। প্রথম দিন (মঙ্গলবার) কিছু না বললেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা দ্বিতীয় দিন (বুধবার) বিষয়টি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টিতে আনেন। তিনি আদালতে বলেন, বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী অবসরের পর সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এ অবস্থায় যদি আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়তে আদালতে আসেন, তবে তা হবে চরম নৈতিকতাবিরোধী।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, ‘দীর্ঘদিন চাকরি করার পর বিচারপতিরা এক বছর পর্যন্ত গাড়ি-বাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। এটা তাদের প্রিভিলেজ (সুযোগ)। এ বিষয়ে সবারই সতর্ক থাকা উচিত। আমি সাবেক হোক আর সিটিং হোক সবাইকে অনুরোধ করব তারা যেন জাজেস কমপ্লেক্সের মর্যাদা রক্ষা করে চলেন।’
ভোগ করছেন অবসর-পরবর্তী সরকারি সুযোগ-সুবিধা * পেশাগত নৈতিকতাবিরোধী বলছেন আইনজ্ঞরা * জাজেস কমপ্লেক্সের মর্যাদা রক্ষার আহবান প্রধান বিচারপতির
আদালত থেকে বের হয়ে এ প্রসঙ্গে সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মীর কাসেম আলীর আপিলের শুনানি চলাকালে অ্যাটর্নি জেনারেল আমার প্র্যাকটিসের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। তখন প্রধান বিচারপতি সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেয়া অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান বিচারপতিদের আদালতের নিয়ম-কানুন মেনে চলার আহ্বান জানান। আমি তখন বলেছি, মাই লর্ড অতীতেও আমি এর অপব্যবহার করিনি, এখনও করছি না। আর কয়েক মাস আছি (সুবিধা নিতে পারব), আমি ভবিষ্যতেও এর অপব্যবহার করব না। আমি আইন মেনে আইন পেশায় কাজ করছি। সংবিধান আমাকে ক্ষমতা দিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের ২-এর (১) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদে বহাল থাকলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের পর তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি বা কার্য করিতে পারিবেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকাবস্থায় এ মামলায় তার (নজরুল ইসলাম চৌধুরী) না থাকাই বাঞ্ছনীয়। প্রধান বিচারপতি সব জাজের উদ্দেশে বলেছেন, যারা জাজেস কমপ্লেক্সে বাস করেন তারা এ ভবনের মর্যাদা রক্ষা করে চলবেন। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী শুনানিতে অংশ নিতে পারেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইনগতভাবে বাধা নেই তবে এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। আমি মনে করি এটা নৈতিকতাবিরোধী। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী যদি সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন তাহলে আমাদেও কোনো কথা থাকবে না।
এ সময় তিনি আরও বলেন, আমরা এতদিন শুনে এসেছি মীর কাসেম আলীর জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা, বিত্তশালী। শুনেছি মীর কাসেম আলী বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। এখন সে কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। মীর কাসেম আলী বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন সেটা যথোপযুক্ত। তবে অবসরপরবর্তীতে একজন বিচারপতি কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না- সে ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেমকে ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন তিনি। ৯ ফেব্র“য়ারি থেকে তার আপিলের শুনানি শুরু হয়। বুধবার থেকে এ আপিলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেছেন তার আইনজীবীরা।যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই