মে থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি বাস্তবায়ন শুরু

জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। এখন থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সব বিষয় দেখভাল করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সমন্বয় সভায় এই নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে চার হাজার ৩৬৫টি বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে।

সমন্বয় সভা সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত সিদ্ধান্তের ফলে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায় অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি, এরপর একাডেমিক স্বীকৃতি, পরে ওই সব প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির (শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রদান) সিদ্ধান্ত নেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত শ্রেণিখোলা কিংবা বিষয় খোলার প্রয়োজন হলে তার অনুমতিও দেবে তারা। এত দিন পর্যন্ত এসব সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা বোর্ডগুলো দিত।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর প্রক্রিয়া আগামী মে-জুন মাসে শুরু হবে বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজনীয় কার্যক্রমও সম্পাদন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ওই সমন্বয় সভা। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখার অতিরিক্ত সচিব ও দুজন যুগ্ম সচিব।

সভাশেষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ূন খালিদ বলেন, ‘২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই আলোকে দুই মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আমাদের অধীনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ তিনি জানান, নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কারিকুলামও ঢেলে সাজানো হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হলে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি পরীক্ষাই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেবল অষ্টম শ্রেণির সমাপনী জেএসসিটাই হতে পারে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে এক হাজার ৩৮টি। আর পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হচ্ছে তিন হাজার ৩২৭। নতুন করে পাঠদানের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে ৯২টি এবং একাডেমিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছে ৩২টি প্রতিষ্ঠান। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন করে একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্তও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেবে।

গত ছয় মাস ধরে একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতি স্থগিত রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতি সরকারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হবে নাকি ওই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দেবে তা চূড়ান্ত হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী দিনে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখভাল করবে ওই মন্ত্রণালয়। সচিব জানান, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে শিক্ষার তিনটি স্তরের মধ্যে প্রাথমিক স্তর হচ্ছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত এবং পরবর্তী স্তর হচ্ছে উচ্চশিক্ষা স্তর। যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে তিন স্তরের শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকার তত্পর।

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করা হবে; অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। এটি করতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে, আর্থসামাজিক অবস্থা ও জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) নতুন করে প্রাথমিকের উপযোগী করে পাঠ্যক্রম প্রণয়নের তাগিদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে জানা গেছে। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর পাঁচ বছর চলে গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা বা রূপরেখা এখনো তৈরি করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাঠ্যক্রম প্রণয়নেও অগ্রগতি নেই। জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার জন্য আন্তমন্ত্রণালয় সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে ২০১৩ সালে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটি কোনো সভাই করেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী না হওয়ায় এ কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছিল। মন্ত্রণালয়টি বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছিল না।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা আট বছর মেয়াদি করার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে। ওই বছর ৫০৩টি উপজেলা বা থানায় ৫০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত চালু হয় ৫৯৬টি বিদ্যালয়ে। পর্যায়ক্রমে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি খোলার মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ বছর অষ্টম শ্রেণি খোলা হয়েছে। এগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা গত জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার অনুমতি নিতে হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে। এ নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের।

২০১৪ ও ২০১৫ সালে আরো ১৭৩টি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই