মৃত ভেবে অন্য লাশের সঙ্গে আম্মুকেও ফেলে রাখা হয়েছিল

জহুরা মাহ্জাবীন মন্দিরা : একুশে আগস্ট বিকেল। আমি তখন টিচারের কাছে পড়ছি। পরের দিন আমার মিডটার্ম পরীক্ষা। ফোনের শব্দে দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলাম। আব্বু-আম্মু এসময় আমার খোঁজ নিতে ফোন করেন। ফোনটা ধরেই শুনতে পেলাম মানুষের হাহাকার, আর্তচিৎকার আর গগনবিদারী কান্নার শব্দ। খানিকের জন্য আতকে উঠলাম। মনটাও হঠাৎ কেমন যেন কামড় দিয়ে উঠলো। সাহস করে হ্যালো বললাম। কোনো সাড়া নেই ওই প্রান্তে। কেবলই মানুষের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ আমার ড্রাইভারের গলার শব্দ শুনতে পেলাম।

বললেন, ‘মন্দিরা তোমার আব্বুর মোবাইল নম্বর দাও তাড়াড়াড়ি’। আমি জিজ্ঞেস করলাম মামা আম্মু কোথায়। আমাকে উত্তরে বললেন, ‘নেত্রী কোথায় (শেখ হাসিনা) সেটাই কেউ জানে না’। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। শুধু আব্বুর ফোন নম্বরটা কোনোভাবে মনে করে দিলাম। আব্বু-আম্মুর মোবাইল নম্বর আমার মুখস্ত। কিন্তু মানুষের সেই চিৎকার, হাহাকার আর ড্রাইভারের আতঙ্কিত ভাঙা ভাঙা গলা আমাকে বিচলিত করে ফেলছিল। আমি কিছু না বুঝে- না জেনেই কাঁদতে শুরু করলাম।

আব্বুকে ফোন দিচ্ছি, মামাদের ফোন দিচ্ছি- কেউই ফোন ধরছে না। কী করবো, কোথায় যাবো কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। প্রায় ৩০ মিনিট এভাবেই কেটে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন বছরের মতো কাটছিল। হঠাৎ খবর এলো (বাসায় কে যেন এসেছিল মনে নেই) আম্মু আর নেই। আমি প্রায় আধ পাগল। হঠাৎ আব্বু ফোন দিলো।

হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বল­লো, ‘তোমার আম্মু ভালো আছে। চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু আব্বুর গলাটা কেন যেন ভারী ভারী লাগছিল। আগে কখনো আব্বুর কণ্ঠস্বর এরকম লাগেনি। ভয়টা মনে হয় আরো বেড়েই গিয়েছিল আব্বুর সঙ্গে কথা বলার পর। আস্তে আস্তে আত্মীয়-স্বজন বাসায় আসতে শুরু করলেন। কেউ আসছেন আম্মুর খবর জানতে আর কেউ আসছেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে।

এক পর্যায়ে আব্বু বাধ্য হয়ে বলেই ফেললেন নেত্রীর (শেখ হাসিনা) ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তবে উনি সুস্থ আছেন। কিন্তু তোমার আম্মুর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আব্বু, খোরশেদ মামা, মামুন মামা আর ফারুক মামা একেকজন একেক হাসপাতালে গিয়ে আম্মুুকে খুঁজছে। কিন্তু আম্মুর কোনো সন্ধান দিতে পারছে না কেউ। পরে শুনলাম পান্থপথ সমরিতা হাসপাতালের রিসিপশনের পাশে ফেলে রাখা হয়েছে আম্মুকে।

মৃত ভেবে অন্য লাশের সঙ্গে আম্মুকেও ফেলে রাখা হয়েছিল। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ ছিল আম্মুর। জিবটাও অর্ধেক বের হয়েছিল। পুরো শরীর রক্তাক্ত। শুনেছি লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় আম্মুকে কোলে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আম্মুর পরিচিত একজন আঙ্কেল পরে আমাকে বলেছিলেন, ডাক্তার নাকি আম্মুকে দেখেই বলেছিলেন- সরি, ‘কিছুই করতে পারবো না’।

আম্মুর খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক মানুষ সমরিতায় জড়ো হয়েছিল। তারা আম্মুকে সমরিতার রিসেপশন থেকে উঠিয়ে নিয়ে অনেক হাসপাতালেও গিয়েছিলেন ট্রিটমেন্টের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য কোনো হাসপাতালই ভর্তি নেয়নি। তাদের সঙ্গে কোনো গাড়িও ছিল না। টেম্পুতে করে আম্মুকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে গেছেন আম্মুর শুভাকাঙ্ক্ষিরা।

এক পর্যায়ে কয়েকজন পরিচিত ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক আম্মুকে মিরপুর ১ নম্বরের কাছে সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। আম্মু তখন ওই এলাকার নির্বাচিত কমিশনার। বিএনপি সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন আম্মু সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিল। সে সুবাদেই আম্মুকে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিনতে পারেন ও দ্রুত ভর্তি করে নেন। সেখানে তখন ড. মেহেদী আমাদের জন্য বলতে গেলে ফেরেশতা হয়ে আসেন। উনিই আম্মুকে ভর্তি নেন। দুর্ভাগ্য আমাদের ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরও নানা কস্টে আম্মুকে স্যালাইন দেয়া হয়। আম্মুর শরীর তখন রক্তশূন্য। রক্ত দেয়াও শুরু হয়। খবর পেয়ে আমরা সবাই ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আম্মুর তখনো জ্ঞান ফেরেনি।

রাতে চ্যানেল আইয়ের টক শো ‘তৃতীয় মাত্রায়’ ও বিভিন্ন নিউজে আম্মুকে মৃত বলে ঘোষণা দেয়া হয়। তখন সবই কেমন যেন উল্টো পাল্টা লাগছিল। চোখের সামনে আম্মুর এমন অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আম্মুর সারা শরীর তখন দগদগে ক্ষত। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। সাদা আর ফিরোজা কালারের শাড়ি পরা ছিল আম্মুর। সাদা শাড়ি রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আম্মুর কাছে থাকতেও দিচ্ছিল না আমাকে। টানা দুইদিন একটা শরীর হাসপাতালের বিছানায় পরে ছিল মরা লাশের মতো। দুইদিন পর হঠাৎ একটু চোখ মেললো আম্মু- আর বিড়বিড় করে জিজ্ঞাস করল নেত্রী (নেত্রী হাসিনা) কোথায়? আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। কোনো সাড়া নেই।

সেদিন এতবার আম্মু আম্মু বলে ডাকলাম একবারও সারা দিল না। চতুর্থ দিন আবার একটু চোখ মেললো এবারো আস্তে আস্তে জিজ্ঞাস করলো আইভী আপা বেঁচে আছে তো? তাকে বোমা মেরেছে। আব্বু ছিলেন তখন অম্মুর পাশে। বললেন, সবাই ভালো আছে। তুমি টেনশন করো না। আব্বুর কথা বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। আবার নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। টানা ছয়দিন আর চোখ মেললেন না। হাতে স্যালাইন চললে, কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না আম্মু বেঁচে আছেন না কি নেই?

আব্বু-আম্মু ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। আমিও তাদের একমাত্র সন্তান। কাজেই আব্বু আর আমার দুনিয়াজুড়ে আম্মু। আম্মুকে ছাড়া বেঁচে থাকার কোনো উৎসই ছিল না আমাদের। অনেক কষ্ট আর আশঙ্কার মধ্যে দিন যেতে লাগালো। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর অপারেশন থিয়েটারে নিতে না নিতেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমাদের এক চিমটি আশার আলো ধপ করে নিভিয়ে দেয়ার মতো ছিল। ওই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই আম্মুর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করে স্পি­ন্টার বের করতেন ডাক্তার।

সাত দিনের মাথায় আম্মুর জ্ঞান আসে। আমরা কিছুটা হলেও আশাবাদী হলাম। কিন্তু ঠিক সেদিনই আরেক দুর্ভাগ্যজনক খররে আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ডাক্তার আমাদের জানালেন আম্মুর পা কেটে ফেলতে হবে। সারা শরীরে যেন ইনফেকশন ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য পা কেটে ফেলতে হবে। আম্মুকে প্রতিদিনই রক্ত দেয়া লাগতো। আল­্লাহর অশেষ রহমত আর মানুষজনের ভালোবাসা ছিল যে সকাল থেকে এসে মানুষজন বসে থাকতো আম্মুকে রক্ত দেয়ার জন্য। ঢাকার বাইর থেকেও অনেকে আম্মুকে রক্ত দিতে হাসপাতালে এসেছিলেন।

ডাক্তারের কথা শুনে আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। আব্বুকে বললাম, আম্মুর যেন পা কেটে ফেলা না হয়। ডাক্তার আমার কথা শুনে বললেন, পা কেটে না ফেললে তোমার আম্মুকে বাঁচানো যাবে না। নবম দিনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আম্মুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে দীর্ঘ দু`মাস আম্মু ভর্তি ছিলেন। আব্বুও ঠিক ছায়ার মতো ওই সময় আম্মুর সঙ্গে লেগেছিলেন।

আম্মু উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা ঠিকমতো বসতেও পারতো না। আব্বু তখন আম্মুকে ছোট্ট শিশুর মতো হাত ধরে দু-পা দু-পা করে নুতনভাবে হাঁটতে শিখিয়েছেন। এরমধ্যে স্পি­ন্টারগুলো বের করার জন্য প্রায় প্রতিদিনই চলতো নানা রকম অপারেশন। আল্লাহর রহমতে সব অপারেশনই সফল হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর পা কেটে ফেলতে হয়নি। তবে ডান পায়ের তলায় এখনো মাংস নেই। গর্ত হয়ে আছে পায়ের মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে। আম্মুর শরীরে এমন কোন জায়গা বাদ ছিল না যেখানে সেই ভয়াবহ গ্রেনেডের স্পি­ন্টার আঘাত করেনি। মাথা, কান, পিঠ, গলা, হাত, পা, বুক, সব জায়গায় রয়েছে স্পি­ন্টার। শত শত স্পি­ন্টার। অপারেশন করেও অনেক স্পি­ন্টার বের করা সম্ভব হয়নি। এখনো শত শত স্পি­ন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে আমার মা।

সামান্য একটা কাঁটা ফুটলেই আমরা ওই কাঁটা বের না করা পর্যন্ত ব্যাথায় কাঁতরাতে থাকি। আর সেখানে আমার মা এবং তার মতো আরো কত মা-বাবা এই স্পি­ন্টার শরীরে নিয়ে দিনের পর দিন অসয্য যন্ত্রণায় জীবন যাপন করছেন। স্পি­ন্টারের প্রতিক্রিয়ায় মাঝে মাঝে শরীরজুড়ে তীব্র ব্যাথা হয় আম্মুর। তখন সারারাত ঘুমাতে পারেন না। ব্যাথায় কাঁতরাতে থাকেন। যন্ত্রণায় ছটফট করেন। আম্মুর আর্তচিৎকার আর কষ্টে সেদিন আমাদের পুরো পরিবারের কারো চোখেই ঘুম আসে না। এই যেন এক দুঃসহ যন্ত্রণা। তখন খুবই কষ্ট হয় সহ্য করতে।

এত কিছুর পরও আমরা আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া জানাচ্ছি। আমার আম্মু এখনো জীবিত। আমার মা কোনো যুদ্ধ করেননি। কিন্ত তারপরও আমার কাছে আমার মা একজন বীর যোদ্ধা। মৃত্যুকে তিনি জয় করে আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন এবং প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে চলছেন তার শরীরের সঙ্গে। এই ভালো থাকেন, আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরও মনের জোরে সব কাজ- সব দায়িত্ব একইভাবে পালন করে যাচ্ছেন আগের মতো। আমি নিজকে ধন্য এরকম একজন মায়ের মেয়ে হতে পেরে।

ধন্যবাদ জানাই আর মন থেকে দোয়া করি জননেত্রী শেখ হাসিনা আন্টির জন্য। সেদিন আমাদের কষ্টের সময় পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য। তার কাছে এতটুকুই দাবি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যেন এই নির্মম ঘটনার পেছনে কারা জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করা হয়। আর তাদের বিরুদ্ধে বিচার যেন তিনি নিশ্চিত করে যান।

লেখক : জহুরা মাহ্জাবীন মন্দিরা: বৈমানিক, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ



মন্তব্য চালু নেই