মৃত্যু ফাঁদে ঝুঁকিপূর্ণ বাস

হাজারীবাগের ট্যানারি যেমন পুরান ঢাকার বড় অভিশাপ, ঝুঁকিপূর্ণ শত শত ভবন নিয়েও তেমন পুরান ঢাকাবাসীর সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কখন বুঝি তা মাথায় ভেঙে পড়ে! পুরান ঢাকার ১০ থানাতেই আছে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম। অতি সরু অলিগলি পেরিয়ে ৭০ ভাগ বাড়িঘরে পৌঁছায় না অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। বাসাবাড়ির বারান্দা বা ঠিক গেটের সামনেই বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকে বৈদ্যুতিক তার, জনবহুল রাস্তার মধ্যে খোলা জোড়াতালির বিদ্যুৎ সংযোগ, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল এমন হাজারো বিপদ যেন পদে পদে।

ঢাকার অননুমোদিত এবং অতি পুরনো জরাজীর্ণ ভবনগুলো এখন ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণায় ঢাকা শহর ভূমিকম্পের জন্য ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। জরাজীর্ণ এসব ভবন প্রতিমুহূর্তে জানান দিচ্ছে, ঘটতে পারে যে কোনো মহাদুর্ঘটনা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভবনের ৪০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বেশির ভাগই পুরান ঢাকায় অবস্থিত। এসব ভবন রাজউক ও ডিসিসি ২২ বছর আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু এখনো সেখানে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে বহু পরিবার বসবাস করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধান ছাড়াই নির্মিত ও নির্মাণাধীন ভবনগুলো এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, আহসান উল্লাহ রোড, এমনকি বাবুবাজার পুলিশফাঁড়ি, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, চকবাজার, সাতরওজা, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর ও কদমতলী এলাকায় জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনগুলোয় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক লাখ মানুষ।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। আর পাঁচ হাজার ভবন নির্মাণ বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে আগের অবস্থায়। এগুলোকেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজউক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে হেরিটেজ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৫৭৩টি। এর মধ্যে ৩২১টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি ২৫২টি হেরিটেজ ভবন তালিকাভুক্ত রয়েছে। রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা নিয়ে আইনি জটিলতার পাশাপাশি রাজউক ও ডিএসসিসির মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। রাজউক বলেছে, পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজউকই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শতাব্দীর পুরনো এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ির দেয়ালের আস্তর অনেক আগেই খসে পড়েছে। ক্ষয়ে যাওয়া লাল ইটের গাঁথুনি হয়ে পড়েছে নড়বড়ে। দেয়ালে বড় বড় ফাটলের চিহ্ন স্পষ্ট। বৃষ্টি নামলেই দেয়াল বেয়ে পানি পড়ছে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি। তবু উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি নন বাসিন্দারা।

শাঁখারীবাজার এখন আরও বিপজ্জনক : ২০০৪ সালে ছয়তলা বাড়ি ধসে ১৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত শাঁখারীবাজার এখন আরও বিপজ্জনক। সেখানে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া একের পর এক বহুতল

ভবন তৈরি হচ্ছে। পুরো মহল্লাটি এখন অতিঘিঞ্জি বিল্ডিংবস্তি। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব ভবনের অধিকাংশই ১০ তলা বা তারও বেশি। মার্কেটের নাম করে বানানো ভবনগুলোও ভাড়া দেওয়া হচ্ছে আবাসিক বাসাবাড়ি হিসেবে। বাড়ির মালিকরা রাজউকের ভবন নির্মাণ আইন ‘বিল্ডিং কোড’ বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করছেন না। পাঁচ-সাত ফুট রাস্তার পাশেই গড়ে তুলছেন ১১-১২ তলা মার্কেট। বাড়িতে ঢোকার রাস্তাও নেই ঠিকমতো। পুরান ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম ইসলামপুর রোডে অবৈধভাবে ১৪ তলা ভবন নির্মাণের কাজ স্থানীয়রা অভিযোগ দিয়েও থামাতে পারেননি।

এ ব্যাপারে রাজউকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট অথরাইজ অফিসার জানান, ইসলামপুর রোডের সামনে ও পাশে বড়জোর ৯ ফুট প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে, সেখানে ১৪ তলা দূরের কথা, পাঁচতলা বাড়ি বানানোরও অনুমতি নেই। এর পরও সেখানে প্রকাশ্যে বেআইনিভাবে বহুতল ভবন কীভাবে গড়ে উঠছে, রাজউক কর্মকর্তা সে প্রশ্নের জবাব দেননি।

চুন-সুরকির প্রলেপ : শাঁখারীবাজারে বিপজ্জনক ভবন রয়েছে ১৪২টি। এর মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ২৬টি বাড়ি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শাঁখারীবাজারের বেশ কয়েকটি বাড়ির দেয়াল ও ছাদে মারাত্মক ফাটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই গজিয়ে উঠেছে বৃক্ষলতা। শাঁখারীবাজার রোডের উভয় পাশে অন্তত ৩০টি বাড়িতে মাঝেমধ্যেই চুন-সুরকির প্রলেপ লাগিয়ে ‘মজবুত ভবন’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু সেসব বাড়ির বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, সামান্য ঝোড়ো বাতাসেও ভবনগুলো ভয়ংকরভাবে কাঁপতে থাকে। তাঁতীবাজার এলাকার বাসিন্দারা কোতোয়ালি রোডের আহাদ মার্কেট প্রসঙ্গে একই ধরনের অভিযোগ তোলেন। ওই এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, মাত্র চার ফুট প্রশস্তের রাস্তাতেই ১০ তলার ‘মার্কেট-কাম-ফ্ল্যাটবাড়ি’ নির্মিত হয়েছে। উচ্ছব পোদ্দার লেনে পুরান বিল্ডিংয়ের ভিত্তির ওপর সাততলা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের নমুনাও দেখান এলাকাবাসী। অ্যাপার্টমেন্টটির সামনে বড়জোর ৭-৮ ফুট চওড়া একটি রাস্তা আছে। তবে সে রাস্তায় গাড়ি চলাচলের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শাঁখারীবাজারসহ আশপাশের ইসলামপুর, কোতোয়ালি রোড, উচ্ছব পোদ্দার লেনে রাজউক অনুমোদিত বৈধ বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তারা জানান, বাধা দেওয়ার পরও এসব নির্মাতা কোনো তোয়াক্কাই করেন না। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর ভেঙে ফেলার ব্যাপারে আন্তমন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশ এখনো ‘কাগুজে সিদ্ধান্ত’ হিসেবেই ফাইলবন্দী হয়ে আছে। সমন্বিত বৈঠকের অতিজরুরি নির্দেশ এক যুগেও আলোর মুখ দেখেনি। জরাজীর্ণ ভবন ভাঙার কাজ শুরু করা দূরের কথা, এ পর্যন্ত মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকাও চূড়ান্ত করা যায়নি। অথচ অনেক বাড়ির পাকা দেয়াল ধসে পড়েছে। কোনোটিতে খুঁটির সাহায্যে ঠেকা দিয়ে চলছে বিপজ্জনক বসবাস। বেশির ভাগ ভবনের চুন-সুরকি খুলে পড়ছে, ছাদ চুইয়ে পড়ছে পানি। অনেক বাড়ির ছাদে গাছ গজিয়ে উঠেছে, দেয়ালের সিমেন্ট-বালু ধসে পড়ছে বিপজ্জনকভাবে। বাড়িগুলো রীতিমতো আতঙ্কের বসবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপর্যয়ের হুমকি মাথায় নিয়েই দিনাতিপাত চলছে লাখো মানুষের।

তালিকার জটলায় সবকিছুই শেষ! : ঢাকা জেলা প্রশাসনের তালিকায় ১২০০ ঘরবাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদী ও অর্পিত সম্পত্তি দখল করে গড়ে ওঠা বাড়িঘরগুলো ভিত্তি ধরেই জেলা প্রশাসন এ তালিকা প্রণয়ন করেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালিকায় জরাজীর্ণ ভবনের সংখ্যা ৫৬৭টি উল্লেখ করা হলেও এ মুহূর্তেই ভেঙে ফেলার জন্য ১৬৫টি ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ তালিকাটিও সঠিক নয় বলে দাবি করে নগর পরিকল্পনা বিভাগের একজন প্রকৌশলী বলেন, এখনই ভেঙে ফেলার মতো জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা সিটি করপোরেশনের তালিকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এদিকে রাজউকের পুরনো একটি তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর পুরান ঢাকায় দেড় হাজারেরও বেশি বাড়িকে জরাজীর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে সাড়ে ৭০০ ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি এ মুহূর্তেই ভেঙে ফেলা প্রয়োজন বলেও রাজউক কর্মকর্তারা মনে করেন। ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িঘর এ মুহূর্তেই ভেঙে ফেলার ব্যাপারে রাজউকের তৈরি তালিকার সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নগরবিদদের। তাদের দাবি, শাঁখারীবাজারে ভবনধসের পর তড়িঘড়ি করে রাজউক দায়সারা গোছের তালিকা বানিয়েছে।

অবৈধ কারখানা, কেমিক্যালের ছড়াছড়ি : পুরান ঢাকায় বিপজ্জনক কেমিক্যালের কারখানা-গুদাম-দোকান থাকবে, নাকি মানুষ বসবাস করবে এখন তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। তারা বলেছেন, পুরান ঢাকার মৃত্যুফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদামগুলো সাত বছরেও অপসারণ করা যায়নি। বাসাবাড়ির মধ্যেই বহাল তবিয়তে রয়েছে ২৫ সহস্রাধিক কারখানা। যে কোনো মুহূর্তে নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় তটস্থ থাকছে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ। তাদের অভিযোগ, দায়িত্বশীল মহল গুটিকয় ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষায় লাখ লাখ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

রাজধানীর নিমতলীতে কেমিক্যালজনিত আগুনে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের পর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বেশ তত্পর হয়ে ওঠে। আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জনবসতিস্থল থেকে বিপজ্জনক কারখানাগুলো অবিলম্বে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর নানা উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামে। অবৈধ কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামের বিরুদ্ধে শুরু হয় মোবাইল কোর্টের অভিযান। তবে এত সব উদ্যোগ-আয়োজন দুই মাসের মধ্যেই ঝিমিয়ে পড়ে। আন্তমন্ত্রণালয়ের জরুরি সিদ্ধান্তটিও পরিকল্পনার ফাইলপত্রে গণ্ডিবদ্ধ হয়। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ, ঢাকাবাসীর দাবি, মিছিল-মিটিং, নাগরিক আন্দোলন মোটেও পাত্তা পায় না। ফলে কেমিক্যাল কারখানা-গুদামের সঙ্গে সহাবস্থানকারী বাসিন্দাদের রাত-দিন কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে।

গত কয়েক দিন লালবাগ, চকবাজার ও বংশালের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে অলিগলি, ঘন-ঘিঞ্জি আবাসিক বাড়িঘরেই কেমিক্যাল কারখানাসহ নানা রকম বিস্ফোরকের মজুদ লক্ষ করা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা দক্ষিণ জোনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ বসতবাড়িতে নানা ধরনের বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম বানানো হয়েছে। সেসব কারখানায় সালফার, পটাশ, ফসফরাস, সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, ইথানল, মিথাইল, রেকটিফায়েড স্পিরিট, ফরমালডিহাইড, অ্যাডহেসিভ বা সলিউশন, তারপিনসহ নানা ধরনের গানপাউডার-বিস্ফোরকের অবাধ ব্যবহার চলছে।-এমজমিন



মন্তব্য চালু নেই