মৃত্যুর ওপারেই তাদের স্কুল!

দুটো লোহার জালের প্রাচীরের ফাঁক গলিয়ে আরেকটি কংক্রিটের ডিভাইডার লাফিয়ে এপারে এসেছে ছোট্ট সানি। শত শত ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কারের মাঝখান দিয়ে ছুটে এসেছে সে। মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল, ঘটতে পারত দুর্ঘটনা! প্রাণটা হাতে নিয়ে ছোট্ট সানির কেন এই ছুটে আসা? একটি বিমর্ষ উত্তর- মৃত্যুর ওপারেই তার স্কুল!

প্রতিদিন সানির মতো শতাধিক শিশু শিক্ষার্থী উত্তর কুতুবখালী থেকে দক্ষিণে রসুলপুরে অবস্থিত ৩৮ নম্বর কুতুবখালী দাগু খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে যায়। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের যে পথটি সোজাসুজি চিটাগং রোডে চলে গেছে, তার শেষ প্রান্তে টোল আদায়ের দুই কাউন্টারের মাঝখানে এই স্কুলটি। এপারে রাস্তার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি স্কুল- কুতুবখালী উচ্চবিদ্যালয়। ফ্লাইওভারের উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত এই দুটি স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই রাস্তা পার হচ্ছে।

অভাবের সংসারের কারণে মা সালমা আক্তার ভালো কোনো খেলনা কিনে দিতে পারে না। টিফিনের পয়সাও তার পকেটে নেই। মন চাইলেও চকলেট, বিস্কুট কিংবা একটা শিঙাড়াও কিনতে পারে না সে। ভালো কোনো প্যান্টও তার নেই। স্কুলের দেওয়া সরকারি জামাটাও মলিন, ধুলাবালির দাগে ভরা। সাবান-সোডা কেনাও যে কষ্টকর, তা চুল আর চেহারায় ফুটে উঠেছে সানির। ঝিয়ের কাজ করে বলে ঠিক সময়ে স্কুলে নিতে আসে না মা। একা একা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে রাস্তার এপার-ওপার করতে হয় তাকে।

শত অভাবেও পড়ালেখা করার দৃঢ় সংকল্প তার। ছোট্ট সানি জানায়, বড় হয়ে সে চাকরি করবে। এর চেয়ে বড় কিছু আশা নেই তার। কেন চাকরি করতে চায়?

প্রশ্ন শুনে থ, কিছুটা বিস্ময় আর আবেগেও মনটা ভরে উঠল তার, ‘মায়ের কষ্ট ভুলাইবো। টাকা কামাইবো। ভালা থাইকবো।’ রিকশাচালক বাবা তার মাকে ছেড়ে যাওয়ার পর যে দুর্দশা এই ছোট্ট শিশুটির হৃদয়ে গেঁথেছে, তা লেখাপড়া শিখেই ঘোচাতে চায় সানি। এ জন্য এই মৃত্যুফাঁদ ফ্লাইওভারের লোহার জালের প্রাচীর আর ডিভাইডার বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এমন দৃঢ় মনোভাব দেখালো এই অবুঝ শিশুটি।

সানির মতো রুনি, বীথি, সায়লা ও মাসুদের পারিবারিক অবস্থা প্রায় একই। ওরা খেটে খাওয়া চরম নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিন্ডারগার্টেন বা ভালো স্কুলে পড়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। মা-বাবারা দিনমজুর বা ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালান। লেখাপড়া শিখতে হলে এই ঝুঁকি নিয়েই তাদের এপার-ওপার করে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হবে।

উত্তর কুতুবখালী মসজিদের কাছে বাসা মাসুদের। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। বাবা যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে কাজ করেন। সে জানায়, রাস্তার ওপারের স্কুলে যেতে হলে হয় যাত্রাবাড়ী, নয়তো পূর্বের কাজলা পেট্রলপাম্পের পাশ দিয়ে ঘুরে আসতে হয়। এতে প্রায় এক কিলোমিটার ঘুরতে হয় তাদের। এ জন্য কষ্ট হলেও এই ঝুঁকি নেয় তারা। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, বিপদ হতে পারে ভয়াবহ- তা নিয়ে ভাবে না এই শিশুরা। শুধু জানে এই পথে তাড়াতাড়ি স্কুলে যাওয়া-আসা করা যায়।

চায়ের দোকানে কথা হয় রসুলপুরের মধ্যবয়সি মোতালেব সরদারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এই স্কুলটি স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। তখন এই এলাকার সব শিশুই পড়ত। এখন এটা গরিবদের স্কুলে পরিণত হয়েছে। যাদের একটু সামর্থ্য আছে তাদের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ে না।
কণ্ঠস্বর কিছুটা চড়িয়ে অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে মোতালেব বলেন, ‘বড়লোকের পোলাপান পড়লে এত দিন এইখান দিয়া ওভারব্রিজ হইতো। কে ভাববো গরিবের পোলাপানের কথা, তাদের নিরাপত্তার কথা।’

অভিযোগ নয়, অনেকটা অনুযোগের সুরে সুর মেলালেন এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক। তিনি জানালেন, এটা সরকারি স্কুল। যে কারণে অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়। তার পরও তিনি শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওভারব্রিজের দাবি করেছেন। শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চেয়েছেন। রাস্তায় প্রতিবাদ করার ছবি দিয়েছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। আবেদনও করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, ফ্লাইওভার করার সময় ওভারব্রিজের কোনো নকশা না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রধান শিক্ষক অবশ্য জানিয়েছেন, এই পথে ছাত্রছাত্রীদের রাস্তা পারাপারের জন্য একজন ট্রাফিক পুলিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা দু-এক দিন দায়িত্ব পালন করার পর এখন আর আসেন না। ফলে সেই ঝুঁকি নিয়েই বাদুড়ঝোলা হয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তা পার হচ্ছে। এতে কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে, সেই দুশ্চিন্তায় থাকেন শিক্ষকরা।

পরিসংখ্যান বলছে, ফ্লাইওভার হওয়ার আগে রাস্তার ওপার থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী আসত। এখন তা ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ হাজার ২৪০ জন। ওভারব্রিজ হলে আরো শিক্ষার্থী বাড়ত বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক ।

একই কথা বলেছেন রাস্তার উত্তরে অবস্থিত কুতুবখালী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন। তিনি বললেন, আগে অনেক ছাত্রছাত্রী আসত দক্ষিণ কুতুবখালী এবং রসুলপুর থেকে। এখন একদম আসে না। যারা indexনবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছে, তারা মাঝে মাঝে স্কুলে আসে। নতুন করে দক্ষিণের কোনো ছাত্র আর এখানে রেজিস্ট্রেশন করে না।

তিনি জানান, এখানে ওভারব্রিজ করার জন্য শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওভারব্রিজের দাবি করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্কুলের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কেউ এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি।

শিক্ষকরা জানালেন, ফ্লাইওভার দরকার ছিল। যানজটমুক্ত ঢাকা শহর গড়তে এই উন্নয়নমূলক কাজকে তারা স্বাগত জানান। পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে দিকটিও ভাবা দরকার বলে মনে করেন তারা।

ফ্লাইওভার কুতুবখালীর উত্তর ও দক্ষিণের যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ আর ইচ্ছে করলেই রাস্তার এপার-ওপার যেতে পারেন না। এর জন্য তাদের এক কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়। এতে সময় এবং ঝুঁকি দুটোই আছে। এ কারণে, শুধু স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, সাধারণ মানুষেরও জন্য এই পয়েন্টে একটি ওভারব্রিজ জরুরি বলে মনে করেন এলাকাবাসী।



মন্তব্য চালু নেই