মৃত্যুর আগে তাদের শেষকথা

মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে শেষকথা নিয়ে ইংরেজ লেখক চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন উপন্যাস ‘এ টেইল অফ টু সিটিজ’ (১৮৫৯)এ। উপন্যাসের নায়ক সিডনি কার্টনের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বলা কথাগুলো এখনো বিশ্বসাহিত্যে কালজয়ী হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় এটি মানুষের মুখে মুখেও উচ্চারিত হয়েছে।

তবে উপন্যাসের চরিত্র শুধু নয়, বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া সক্রেটিস কিংবা ক্ষুদিরাম বসুর শেষ কথাও বিশ্বে কম আলোচিত হয়নি। মৃত্যুর পূর্বে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে তাদের শেষ কথা অথবা প্রিয়জনের কাছে লেখা শেষ চিঠিতে তাদের বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে সাজানো হলো এই প্রতিবেদন।

সক্রেটিস : ‘দর্শনের পিতা’ বলা তাঁকে। ৭০ বছর বয়সে তাকে হেমলক খেয়ে মৃত্যুদণ্ডে বাধ্য করা হয়েছিল তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পরিণতি দুটি হতে পারে। এক. মৃত ব্যক্তি পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যেতে পারে তার কোনো অনুভূতিই থাকবে না। দুই. বলা হয়, একটা বিশেষ পরিবর্তন হবে- আত্মা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে। মৃত্যু যদি সকল অনুভূতি নিঃশেষ করে দিতে পারে, তাহলে এটা হবে ঘুমানোর মতো, যেখানে ঘুমন্ত ব্যক্তি কোনো স্বপ্ন দেখে না। তাহলে মৃত্যু হবে একটা বড় লাভ … মৃত্যু যদি এ রকমই হয় তাহলে আমি বলব, এটা একটা লাভ। এর ফলে এক রাতের মধ্যে সব ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে, যদি মৃত্যুটি হয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আত্মার স্থানান্তর এবং যা বলা হয় তা যদি সত্য হয়, তাহলে এর চাইতে বড় আশীর্বাদ আর কি হতে পারে- বিচারকবৃন্দ? এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে, এখন মরলে এবং সব যত্নআত্তি থেকে মুক্ত হলে, আমার জন্য ভালো হবে … কিন্তু এখন যাওয়ার সময় হয়েছে, আমার মৃত্যুর সময় হয়েছে … আপনারা বেঁচে থাকবেন। কিন্তু আমি, নাকি আপনারা কে যে ভালো জায়গায় থাকবেন, সেটা ঈশ্বর বাদে কেউ জানেন না।’

প্রথম চার্লস : ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এই রাজা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইংল্যান্ডে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী বিপ্লবী দলের কাছে পরাজিত হন। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে প্রথম চার্লসকে কুঠারাঘাতে শিরচ্ছেদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর আগে প্রথম চার্লস বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত স্থান থেকে আমি চলে যাব এমন একটি স্থানে যেখানে দুর্নীতি নেই। যেখানে কোনো অশান্তি হতে পারে না।’

ষোড়শ লুই : মৃত্যু ১৭৯৩ সালে। ফ্রান্সের রাজা ছিলেন। ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের গিলোটিনে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের ক্ষমা করে দিচ্ছি’।

ক্ষুদিরাম বসু : ১৯০৮ সালে মোজাফফরপুর বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুঁড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয়। রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা?

ক্ষুদিরাম আবার মুচকে হাসলে বিচারক আবার প্রশ্নটি করেন। ক্ষুদিরাম তখন বলেন, ‘আমাকে একটু সময় দিলে আমি সারা ভারতবাসীকে শিখিয়ে দিতাম কী করে বোমা বানাতে হয়’।

ভগত সিং : মৃত্যু ১৯৩১ সনে। ভারতে বৃটিশ শাসনবিরোধী পাঞ্জাবের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী সমাজকর্মী ছিলেন তিনি। বৃটিশ পুলিশ অফিসার জন সনডার্সকে হত্যার অপরাধে ভগৎ সিংকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন যেটি এখনো বিশেষভাবে সমাদৃত : ‘ব্যক্তিকে সহজেই হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বড় বড় সম্রাজ্য ভেঙে গুড়িয়ে গেছে কিন্তু আদর্শ টিকে থেকেছে ঠিকই’।

মাস্টারদা সূর্য সেন : মৃত্যু ১৯৩৪ সনে। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বিপ্লবী মহানায়ক। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু আমার দরজায় এসে গিয়েছে। অনন্তের দিকে আমার মন উড়ে চলেছে … এত সুন্দর, এত কঠিন, এত পূতপবিত্র সময়ে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে যাব? একটাই জিনিস। সেটা হচ্ছে আমার স্বপ্ন মুক্ত ভারতের সোনালি স্বপ্ন। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ তারিখটি কখনোই ভুলে যেও না চট্টগ্রামে পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহের দিনটি … ভারতের স্বাধীনতার জন্য যেসব দেশপ্রেমিক জীবন দিয়েছেন তাদের নামগুলো তোমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে লিখে রেখ।’

কর্নেল আবু তাহের : ১৯৭৫- এ সেনাবাহিনীতে সংঘটিত হত্যা ও দেশদ্রোহিতার অপরাধে ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫- এ গ্রেফতার হন আবু তাহের। বিচারের সময়ে আবু তাহের যে সুদীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন তার শেষাংশ হলো : ‘যা করে থাকি না কেন তার জন্য আমি গর্বিত। আমি ভীত নই। শেষে শুধু বলব, আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালোবাসি। এ জাতির প্রাণে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করবে? নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।’

জুলফিকার আলী ভুট্টো : মৃত্যু ১৯৭৯ সালে। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭-এ একটি সামরিক ক্যুতে পদচ্যুত ও গ্রেফতার হন। নতুন শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের নির্দেশে ভুট্টো বিরোধী দলীয় আহমেদ রাজা কাসুরির পিতা আহমেদ খান কাসুরিকে গুলি করে হত্যার অপরাধে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ভুট্টো তার কন্যা বেনজির ভুট্টোকে যে শেষ চিঠি লিখেছিলেন তার কিছু অংশ হলো : ‘ওই লোকটাকে আমি খুন করিনি। আমার আল্লাহ সেটা জানেন। আমি খুন করে থাকলে সেটা স্বীকার করার মতো সাহস আমার আছে। এখন যে বিপদ ও অপমানের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হচ্ছে, তার চাইতে কম হতো ওই স্বীকারোক্তি। কোনো আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ব্যক্তি এই বর্বর বিচার সহ্য করতে পারেন না। আমি একজন মুসলিম। একজন মুসলিমের ভাগ্য নিয়ন্ত্রা আল্লাহ। আমি পরিষ্কার বিবেক নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারব। তাকে বলতে পারব একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে আমি তার ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে পুনর্গঠিত করে একটা সম্মানজনক অবস্থায় উন্নীত করেছিলাম। মৃত্যুর জন্য আমি ভীত নই। তুমি দেখেছ আগুনের মধ্য দিয়ে আমি কীভাবে হেঁটে গিয়েছি’।

সাদ্দাম হোসেন : মৃত্যু ২০০৬ সালে। ইরাকের বিখ্যাত একনায়ক। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩-এ ধরা পড়ে বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। ফাঁসিতে মৃত্যুর পূর্বে তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন : ‘প্রিয় বিশ্বাসী জনগণ, আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু আমি থাকব পরম করুণাময় আল্লাহর সঙ্গে। তার কাছে যারা আশ্রয় চান তিনি তাদের সাহায্য করেন এবং কখনোই কোনো বিশ্বাসীকে নিরাশ করেন না … আল্লাহ মহান … আল্লাহ মহান … আমাদের জাতি দীর্ঘজীবী হোক … আমাদের সংগ্রামী জনগণ দীর্ঘজীবী হোক … ইরাক দীর্ঘজীবী হোক … প্যালেস্টাইন দীর্ঘজীবী হোক … জেহাদ ও মুজাহেদিন দীর্ঘজীবী হোক’।



মন্তব্য চালু নেই