মুমিনুলের পেট কাটবেন না

গল্পটা তো সবাই জানেন।

সেই যে এক চাষী একবার একটা হাস পেয়েছিল; হাসটা রোজ সোনার একটা করে ডিম পাড়ে। আনন্দে আটখানা চাষী বুঝে উঠতে পারে না, এই হাস লইয়া সে কী করিবে?

রোজ একটা করিয়া ডিমের জন্য অপেক্ষা করবে? নাকি একদিনে পেট কেটে সব ডিম বের করে ফেলবে?

চাষী শেষ পর্যন্ত চাষার মতো কাজ করেছিলো। হাসটাকে কেটে ফেলেছিলো। ডিম তো জোটেইনি; লাভের লাভ হাসটার মাংস খেয়ে পেট ভরেছিলো।

মুমিনুল আমাদের সেই সোনার ডিম পাড়া হাস।

আমরা এখনো মুমিনুলকে কেটে খেয়ে ফেলিনি। তবে সেই চাষীর মতো আহলাদে আটখান হয়ে এক দারুন বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছি।

টেস্ট ক্রিকেটে রোজ দিন এতো এতো রান করতে থাকা মুমিনুলকে আমরা ওয়ানডেতে কী করবো? টেস্টের মতো তিন-চার নম্বরে খেলাবো? নাকি একাদশে রাখবোই না? নাকি সাত-আট-নয় নম্বরে খেলাবো?

এবং সবকিছু এভাবে করে দেখে আমরা হতাশ হয়ে মুমিনুলের দিকে চেয়ে বলছি, বাবা রে! তুই টেস্টের মতো ব্র্যাডমানিয় গড়ে কেন ওয়ানডেতে রান করিস না?

এখন আমরা ওয়ানডেতে মুমিনুলকে নিয়ে কী করবো?

আমার কথা খুব সোজা; কী করবেন, বুঝে উঠতে না পারলে মুমিনুলকে ওয়ানডে খেলানোরই দরকার নেই। অন্তত দলে নিয়ে তাকে এখানে ওখানে ব্যাট করতে পাঠানোর মতো তামাশা করার কোনো দরকার নেই।

মুমিনুলের মাপের ব্যাটসম্যান গাছে ধরে না। ১২ টেস্টে ৬৩.০৫ গড়ে ১১৯৮ রান করে ফেলা ব্যাটসম্যান আপনি দোকানে কিনতে পাবেন না।

প্লিজ ডোন্ট মেস উইথ দ্য বয়।

যদি মনে করি, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, মুমিনুল ওয়ানডেতে চলে না; দেন লিভ হিম আউট।

ভিভিএস লক্ষনের মতো বহু ব্যাটসম্যানকে দুনিয়া দেখেছে; যারা সমসাময়িক ব্যাটিং কিংবদন্তী হয়েও ওয়ানডে ক্রিকেটে শেষ অবদি বিবেচনাতেই ছিলেন না। ফলে টেস্টের লিজেন্ড হয়েও মুমিনুলের ওয়ানডে খেলতে না পারাটা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা অন্তত নয়।

মুমিনুল ভালো, তাই তাকে সব ফরম্যাটে খেলাতেই হবে; এতো ছেলেমানুষী আহলাদ দেখানোর জায়গায় আর বাংলাদেশ নেই। আপনারা ভালো মনে করলে খেলাবেন, নইলে তার আত্মবিশ্বাসে হাত দেবেন না।

এটুকু গেল কথার জন্য কথা; তর্কের জন্য তর্ক।

আমি কী আসলেই মনে করি যে, মুমিনুল ওয়ানডের জন্য নয়?

কক্খনো নয়। আমার বিশ্বাস সব ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার যোগ্যতা মুমিনুলের আছে। উইকেটে একটু সেট হয়ে গেলে যে ধরণের কাট ও ড্রাইভ মুমিনুল করতে পারেন; তাতে শর্টার ফরম্যাটে তার রান পাওয়াটা, বড় ইনিংস খেলাটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার।

এই সময়টাই দিতে পারছে না বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট।

তারা মুমিনুলের কাছ থেকে রান পেতে অধীর হয়ে গেছেন। ফলে ভুলে গেছেন যে, দুনিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলের ব্যাটসম্যান ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ও গতিতে রান তোলে; সবাই চার ছক্কার বন্যা বইয়ে দেয় না; কেউ কেউ স্ট্রাইক রোটেট করে, অড বলে বাউন্ডারি মেরে ইনিংস বড় করে।

মুমিনুল তার ক্যারিয়ারে প্রথম ম্যাচ ব্যাট করেছিলেন ৬ নম্বরে।এরপর তাকে তিন-চারে তুলে আনা হয়। তিনে বিভিন্ন সময়ে ১৫ ম্যাচ, চারে এক ম্যাচ খেলেছেন। এর আগে পরে ৫ নম্বরে এক ম্যাচ, ৭ নম্বরে ৩ ম্যাচ; এমনকি ৯ নম্বরেও ব্যাট করেছেন এক ম্যাচে!

এ সবই হয়েছে, ওই রান পাওয়ার অস্থিরতা থেকে।

অথচ যদি টেস্ট ব্যাটসম্যান মুমিনুলের কথা ভুলে গিয়ে বাংলাদেশের আর দশ জন ওয়ানডে ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তুলনা করেন, টপ ও মিডল অর্ডারে মুমিনুলের গড় বা রান নিতান্ত খারাপ মনে হবে না।

২৬ ওয়ানডেতে ২৩.৬০ গড়ে ৫৪৩ রান করেছেন তিনি।

স্রেফ তুলনার জন্য আমরা বলতে পারি, তামিম ইকবালের ওয়ানডে গড় ২৯.৬৭, মুশফিকের ৩০.০০, ইমরুলের ২৫.৪৩!

এই গড়ের কারণে এদের কখনো ওপেনিং থেকে নয় নম্বরে বা মিডল অর্ডার থেকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হয়নি। মুমিনুলের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অধৈর্য হয়ে দফায় দফায় তাকে একাদশের বাইরেও বের করে দেওয়া হয়েছে।

হয়েছে বলেই এই বেচারার ওয়ানডে ব্যাটিংয়ের অবস্থা দিনকে দিন করুন হচ্ছে।

মুমিনুলকে নিয়ে এসব ছেলেখেলা করার সময় বয়সটা একটু খেয়াল করুন। মাত্র ২৩ বছর বয়সী একটা ছেলে। সে টেস্টে বন্যার মতো রান করছে। অথচ ওয়ানডে এতোটুকু সম্মান পাচ্ছে না। প্রতি ম্যাচে কী পরিমানে নতুন চাপ তার সঙ্গী হচ্ছে, কল্পনা করতে পারেন?

টিম ম্যানেজমেন্টকে বলি।
মুমিনুল যে সম্পদ, সেটা প্রথমে আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে; জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করতে হবে। এরপর তাকে বিশ্বাসটা দিতে হবে। শূন্য রান করলেও পরবর্তী কতোগুলো ইনিংস তাকে খেলাবেন, ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে সিদ্ধান্ত বলাবেন না; এই কথা দিয়ে তাকে ব্যাটিংয়ে নামাতে হবে।

তারপর দেখুন, টেস্টের মুমিনুল ওয়ানডেতে আসে কী না।

বারবার একটা কথা বলি-মুমিনুলের মতো ব্যাটসম্যান সহজে আর পাবেন না। এর সেরাটা নিতে পারলে বাংলাদেশই কৃতার্থ হবে। মুমিনুলকে বিশ্বাস দিন, সেরাটা বের করে নিন।

দয়া করে ছেলেটাকে কেটে খেলে ফেলবেন না।



মন্তব্য চালু নেই