মুজাহিদের প্রধান অপরাধ বুদ্ধিজীবী হত্যা

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাতটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। তবে তার প্রধান অপরাধ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা। এছাড়া এই বদর নেতার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

মুজাহিদের যত অপরাধ

এক, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে সাত-আটজন রাইফেলধারী যুবক রাজধানীর চামেলীবাগে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বাসায় যায়। তারা সিরাজুদ্দীনকে শনাক্ত করে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি লাশও পাওয়া যায়নি। মুজাহিদের নেতৃত্বে ওই ঘটনা ঘটে।

দুই. একাত্তরের মে মাসের এক ভোরবেলায় মুজাহিদ ৮/১০ জন রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালিডাঙ্গি নামের তিনটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা সেখানে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ ঘর জ্বালিয়ে দেন এবং ৫০/৬০ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করেন। ওই গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ জনের নাম-পরিচয়সহ তালিকা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে উল্লেখ আছে।

তিন. একাত্তরের ২৬ জুলাই স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখি নামের এক ব্যক্তিকে ধরে আলফাডাঙ্গা থেকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মুজাহিদ ওই ক্যাম্পে গিয়ে এক পাকিস্তানি মেজরকে কিছু বলার পরে ইউসুফের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাকে সেখানে এক মাস তিন দিন আটক রেখে নির্যাতনের পর যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নির্যাতনে ইউসুফের বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।

চার, একাত্তরের ১৩ মে ফরিদপুর কোতয়ালী থানার খাবাসপুর মসজিদ এলাকা থেকে গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) রণজিত নাথ বাবুকে আটক করে রাজাকাররা। তাকে ফরিদপুরের পুরাতন সার্কিট হাউসে অবস্থানকারী মুজাহিদ ও পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরাইশীর সামনে হাজির করা হয়। রণজিতকে সেখানে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এতে তার একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যার জন্য বিহারী ক্যাম্পে আবদুর রশিদের বাড়িতে রাজাকাররা আটক রাখে। রাতে রনজিত নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচান। এ ছাড়া বিরেন্দ্র নাথ, জলাধর মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র ও উপেনসাহাসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়।

পাঁচ. একাত্তরের ৩০ আগস্ট রাত আটটার দিকে রাজধানীর নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে যান মুজাহিদ ও জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী। সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রুমী (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জহিরউদ্দিন জালাল, আজাদ, বদিউল আলম ও জুয়েলকে দেখে তারা গালিগালাজ করেন। রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করার জন্য তারা পাকিস্তানি সেনাদের পরামর্শ দেন। সেই থেকে তাদের মৃতদেহ আজও পাওয়া যায়নি।

ছয়. একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পরে রাজাকার ও আলবদর গঠিত হওয়ার পর তারাও সেখানে প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালায়। মুজাহিদ ও নিজামী সেখানে নিয়মিত যাতায়াত এবং বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরামর্শ করতেন। ওই ক্যাম্প থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের অগণিত বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়।

সাত. একাত্তরে আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতি দেন। এসবের মাধ্যমে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে প্ররোচনা দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রসংঘের সমাবেশে, সংবাদপত্রের বিবৃতিতে এবং লেখায় মুজাহিদ ওই প্ররোচনা ও উস্কানি দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংগ্রামে মুজাহিদের নামে লেখা ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্তি নয়’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালিকে নিশ্চিহ্নের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা টাউন হলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ছাত্রসংঘের একজন কর্মী জীবিত থাকতেও পাকিস্তানকে ভাঙতে দেওয়া হবে না। দরকার হলে তারা সীমান্তে গিয়ে অস্ত্র ধারণ করবে। ৭ নভেম্বর বিকেলে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে ছাত্রসংঘের গণজমায়েতে মুজাহিদ বলেন, আর কোনো হিন্দু লেখকের লেখা বই প্রচার, বিক্রি বা পড়া যাবে না। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণার সৃষ্টি করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন। এগুলোর মধ্যে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ৫ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২ ও ৪ নম্বর প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয় মুজাহিদকে।



মন্তব্য চালু নেই