মাহে রমজানের ফজিলত ও তার হুকুম আহকাম

চন্দ্রবর্ষ গণনায় ৩৬৫ দিনের মধ্যে রমজানের দিনগুলো হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এই মাস কল্যাণময় মাস। এ মাস কোরআন নাজিলের মাস। রহমত- বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এ মাস তাকওয়া ও সংযম প্রশিক্ষণের মাস। এ মাস সবরের মাস। এ মাস জীবনকে সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়। এ মাস আল্লাহর নৈকট্য ও রেজামন্দি অর্জনের মাস। আল্লাহপাক পবিত্র কালামে ঘোষণা করেন, রমজান মাস_এ মাসে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে আল কোরআন নাজিল হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম তথা রোজা পালন করে। (সুরা বাকারা)।
রমজান আরবি শব্দ ‘রমজ’ ধাতু থেকে এসেছে। ‘রমজ’ ধাতুর দুটি অর্থ আরবি অভিধান ও আরবি সাহিত্যে পাওয়া যায়। এর একটি অর্থ হলো দাহন বা পোড়ানো এবং অপরটি আরব দেশের বছরের প্রথম বৃষ্টি।
এ মাসের নাম রমজান এ জন্য রাখা হয়েছে যে সর্বপ্রথম যখন এ মাসের নাম রাখা হয়েছিল তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। এ জন্য এই মাসের নাম রাখা হয়েছে রমজান। এই পবিত্র মাসকে রমজান এ জন্য বলা হয়, এ মাসে আল্লাহপাক নিজ মেহেরবানিতে সব গুনাহ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেন; মানুষ যেন এক নবজীবন লাভ করতে পারে।
এ সম্পর্কে আল্লাহপাক কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন_হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। এ কতিপয় নির্দিষ্ট দিনের রোজা। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ রোগগ্রস্ত হয় অথবা মুসাফির, তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোতে এই সংখ্যা পূর্ণ করে। আর যাদের রোজা রাখার সামর্থ্য আছে (এর পরও রাখে না) তারা যেন ফিদ্ইয়া দেয়। একটি রোজার ফিদইয়া একজন মিসকিনকে খাওয়ানো। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে কিছু বেশি সৎকাজ করে, তা তার জন্য ভালো। তবে যদি তোমরা সঠিক বিষয় অনুধাবন করে থাকো, তাহলে তোমাদের জন্য রোজা রাখাই ভালো! (সুরা বাকারা)।
বিনা ওজরে রোজা না রাখার পরিণাম : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন_যে ব্যক্তি বিনা ওজরে ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করেছে, অন্য সময়ের সারা জীবনের রোজা তার সমকক্ষ হবে না।
যাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ : প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, মুসাফির নয়_এমন সব মুসলমানের ওপর মাহে রমজানের রোজা পালন করা ফরজ। রোজা সহিহ হওয়ার শর্ত হচ্ছে : ১. নিয়ত করা, ২. মহিলাদের ঋতুস্রাব অর্থাৎ হায়েজ ও নিফাস থেকে মুক্ত হওয়া, ৩. রোজা বিনষ্টকারী বিষয়াদি থেকে দূরে থাকা।
সেহরি খাওয়া : শেষরাতে সুবহে সাদিকের আগে রোজা রাখার নিয়তে যে খাবার খাওয়া হয় তাকে সেহরি বলে। সেহরি খাওয়া সুন্নত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও। কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে।
ইফতার : পূর্ণদিবস রোজা পালনের পর সূর্যাস্তের পরপর আহার গ্রহণের মাধ্যমে রোজার যে পরিসমাপ্তি করা হয় তাকে ইফতার বলে। খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নত। তা না থাকলে পানি দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে ইফতার করা সুন্নত।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ এবং পরবর্তী সময়ে কাজা আদায় করতে হয় : ১. অসুস্থতার কারণে রোজা রাখার শক্তি না থাকলে কিংবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলে অথবা সুস্থতা লাভে বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। ২. অন্তঃসত্ত্বা নারী ও স্তন্যদানকারিণী নারী যদি রোজা রাখেন, তাহলে তাঁর কিংবা তাঁর সন্তানের প্রাণনাশের অথবা অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে তাঁর জন্য রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। ৩. মুসাফিরের রোজা না রাখা কিংবা ভঙ্গ করার অনুমতি আছে।
যেসব কারণে রোজা নষ্ট হয় এবং কাজা ও কাফ্ফরা ওয়াজিব হয় : ১. সঙ্গম করা। ২. পানাহার করা, তা কোনো খাবার হোক অথবা কোনো ওষুধ হোক। ৩. বৃষ্টির ফোঁটা মুখের ভেতর পড়ার পর তা স্বেচ্ছায় গিলে ফেলা। ৪. স্বেচ্ছায় ধূমপান করা। ৫. একটি গম কিংবা ওই পরিমাণ কোনো কিছু গিলে ফেলা।
যেসব কারণে রোজা নষ্ট হয় এবং শুধু কাজা ওয়াজিব হয় : ১. কোনো দৈহিক ওজরের কারণে পানাহার করা। তেমনিভাবে ভুলক্রমে পানাহার করার পর রোজা নষ্ট হয়েছে মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু পানাহার করা। ২. নাক ও কানের ভেতর ওষুধ ব্যবহার করা। ৩. মলদ্বার দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করানো। ৪. খাদ্যদ্রব্য নয় এমন কিছু, যেমন_খেজুরের আঁটি, তুলা, কাগজ, লোহা, কংকর, মাটি অথবা এর টুকরা ইত্যাদি গিলে ফেলা। ৫. কুলি করার সময় পানি গলার ভেতরে চলে যাওয়া। ৬. কানের ভেতর তেলের ফোঁটা কিংবা পানির ফোঁটা দেওয়া। ৮. রাত শেষ হয়নি মনে করে সুবহে সাদিক হওয়ার পর কোনো কিছু আহার করা অথবা স্ত্রী সহবাস করা। ৯. দাঁতের মধ্য থেকে ছোলা পরিমাণ কিছু বের করে খাওয়া।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয় : ১. অপ্রয়োজনে কোনো জিনিসের স্বাদ আস্বাদন করা কিংবা চিবানো। ২. পরনিন্দা করা। ৩. ঝগড়া-ফ্যাসাদ করা। ৪. পূর্ণদিবস নাপাক অবস্থায় থাকা। ৫. টুথপেস্ট, মাজন কিংবা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা। ৬. মুখে থুথু জমিয়ে রেখে গিলে ফেলা।
মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর আমল ও নির্দেশে অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। হজরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত_তিনি বলেন, একদা জনৈক বেদুঈন নবী করিম (সা.)-এর কাছে এল। তার মাথার চুল ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। সে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমাকে বলুন আল্লাহ আমার ওপর কত ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। তখন তিনি বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত। কিন্তু যদি নফল নামাজ পড় তাহলে তা স্বতন্ত্র কথা। অর্থাৎ সেগুলোর সওয়াব ভিন্নভাবে পাবে। লোকটি বলল, আমাকে বলুন আল্লাহপাক আমার ওপর কতটা রোজা ফরজ করেছেন? নবী করিম (সা.) বললেন, গোটা রমজান মাসের রোজা ফরজ। কিন্তু তুমি যদি নফল রোজা রাখ তা হবে স্বতন্ত্র কথা। লোকটি আবার বলল, আমাকে বলুন আল্লাহ আমার ওপর কী পরিমাণ জাকাত ফরজ করেছেন? এবার প্রিয় নবী (সা.) তাকে ইসলামের আইনকানুন ও বিধিবিধান জানিয়ে দিলে সে বলল, সেই মহান সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য বিধান দিয়ে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহপাক আমার ওপর যা ফরজ করেছেন, আমি তার অধিকও কিছু করব না, আর কমও কিছু করব না। (বুখারি শরিফ)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে তখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে, বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দি করা হয় এবং রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় (বুখারি ও মুসলিম)। রমজানের রোজা মানুষের সব গুনাহ ও পাপ প্রবণতা, অন্যায় ও অসৎ মানসিকতা, পাশবিক কামনা-বাসনা এবং আত্মার সব ধরনের কলুষতাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে রোজাদারকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। এই মাসের ইবাদতের মাধ্যমে রোজাদাররা আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর ক্ষমা প্রদর্শন, আল্লাহর জিম্মাদারি, আল্লাহর ভালোবাসা ও আল্লাহর নিয়ামত লাভ করে থাকেন। আল্লাহ আমাদের রোজার পূর্ণাঙ্গ হক আদায়সহ রমজানের দিনগুলোর রোজা পালনের তাওফিক দান করুন।



মন্তব্য চালু নেই