মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে সক্রিয় দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট
বেসরকারিভাবে (বিজনেস টু বিজনেস/বি টু বি) মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। চূড়ান্ত হয়নি কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া, হয়নি সমঝোতা স্বাক্ষরও। অভিবাসন ব্যয়, কর্মীর বেতন ভাতাসহ নানা দিক নিয়ে ঢাকায় সফররত মালয়েশিয়ার কারিগরি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
কিন্তু, এর আগেই দেশটির সম্ভাব্য শ্রমবাজারটি নিয়ন্ত্রণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ জন্য তারা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পদস্থদের সঙ্গে বৈঠকসহ নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
জনশক্তি রফতানিখাতের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ সব তথ্য জানা গেছে।
সরকারের (জি টু জি) পাশাপাশি বেসরকারিভাবে (বিজনেস টু বিজনেস/বি টু বি) বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় বিপুল সংখ্যক কর্মী নেওয়ার ঘোষণা আসে গত জুনে। কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া ঠিক করতে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) মুস্তফা বিন ইব্রাহিমের নেতৃত্বে চার সদস্যের কারিগরি প্রতিনিধি দল বর্তমানে ঢাকা সফর করছেন। ওই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে মঙ্গলবার দুপুরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ম্যাকানিজম (প্রক্রিয়া) এখনো ফাইনাল হয়নি। এটি প্রাথমিক পর্যায়েই আছে।
প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালে জি টু জি (সরকার টু সরকার) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া। শুধুমাত্র গাছ রোপনের কাজে দেশটিতে সরকারিভাবে (জি টু জি) ২০১৩ সালের মার্চ থেকে কর্মী প্রেরণ শুরু হয়। তবে, গত সোয়া দুই বছরে এ প্রক্রিয়ায় মাত্র ৮ হাজারের মত কর্মী গেছে মালয়েশিয়ায়। এ নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের মধ্যে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের বিষয়টি সারা বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দেয়।
এ অবস্থায় মালয়েশিয়া সফরে যান বিদায়ী প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পযায়ের প্রতিনিধি দল। মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চ পদস্থদের সঙ্গে বৈঠক করে গত জুন মাসের শুরুতে মালয়েশিয়ায় বড় পরিসরে (তিন বছরে ১৫ লাখ) বাংলাদেশের শ্রমবাজার উম্মুক্ত হওয়ার সুখবরটি গণমাধ্যমকে জানায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং রিক্রুটিং এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার উম্মুক্তের সুখবরটি আসার পরপরই উভয় দেশের জনশক্তি রফতানি ও আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নড়েচরে বসেন। শ্রমবাজারটি নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু হয় লবিং-দেন দরবার।
সূত্র মতে, মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী দাতো উপাধিধারী বাংলাদেশী দুই ব্যবসায়ী সবচেয়ে বেশি তৎপর। তারা হলেন, মালয়েশিয়ান কোম্পানি রিয়েল টাইমের দাতো আবু হানিফ এবং বেস্টিনেট-এর আমিন নূর। উভয় গ্রুপের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে সাবেক ও বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীসহ সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সির প্রভাবশালী মালিকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেছেন। বাংলাদেশ থেকে যে সব কর্মী মালয়েশিয়ায় যাবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে তাদের তথ্য বা ডাটা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে চায় তারা (কোম্পানি)।
তবে, সাধারণ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীদের ডাটা সংরক্ষণের দায়িত্ব যে কোম্পানিকে দেওয়া হবে মূলত ওই কোম্পানিই শ্রমবাজারটির নিয়ন্ত্রণ করবে। আর এ কারণেই রিয়েল টাইম ও বেস্টিনেট নামের মালয়েশিয়ান দুই কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা উঠে পড়ে লেগেছেন কাজটি পাওয়ার জন্য।
সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী দাতো আবু হানিফের (রিয়েল টাইম) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল ঢাকা আসেন। এ দলে মালয়েশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রীর ভাই ও ভাতিজাও রয়েছেন। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা বেসরকারী জনশক্তি রফতানীকারকদের সংগঠন বায়রা কার্যালয়ে নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর বিকেলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গেও ইস্কাটনে তার দফতরে সাক্ষাৎ করেন তারা। এ বৈঠকে বায়রার সভাপতি আবুল বাশারও উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে মালয়েশিয়ান আরেক ব্যবসায়ী আমিন নূরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের ক্যাটারসিস ওভারসীজের এমডি ও বায়রার যুগ্ম মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনসহ বেসরকারী জনশক্তি রফতানীর সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের কয়েকজন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বর্তমানে আবু হানিফ এবং আমিন নূর এই দুই মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ীর পক্ষে বিপক্ষে সিন্ডিকেট তৈরী হয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এ দুই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে সরকার যেভাবে স্বল্প ব্যয়ে কর্মী পাঠানোর কথা বলছে তা বেড়ে তিন থেকে চার গুণ অর্থাৎ আড়াই থেকে তিন বা আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ সেক্টরে আবারো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার উম্মুক্ত হয়েছে— এমন খবর ছড়িয়ে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সঙ্গে মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী (বেস্টিনেট) আমিন নূর ও বায়রা যুগ্ম মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর বৈঠক প্রসঙ্গে বায়রা সভাপতি আবুল বাশার বলেন, ‘মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী আবু হানিফের রিয়েল টাইম কোম্পানি মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে সব কর্মী বাংলাদেশ থেকে যাবে তাদের তথ্য বা ডাটা সংরক্ষণের জন্য (সফটওয়্যার) প্রতিজনের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১৫ রিঙ্গিত চেয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রস্তাব তারা মন্ত্রী মহদয়ের কাছে দিয়েছেন, যা সরকারের পছন্দ হয়েছে বলে জানি।’
তিনি অভিযোগ করেন, মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ী আমিন নূর এবং ক্যাটারসিস ওভারসীজের এমডি রুহুল আমিন স্বপন গংরা ১০ জন মিলে পুরো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটিতে কাজ করতে বর্তমান এবং সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু, দুই মন্ত্রীই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বায়রা সভাপতি বলেন, ‘আমিন ও স্বপন সাহেবরা যে সিন্ডিকেট করতে চাচ্ছে তা হতে দেব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীও তা হতে দেবেন না। কারণ আমরা চাই বায়রার সব সদস্যই (প্রায় ১২শ’) গণতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা করতে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই, সরকারও যেন আমাদের সহযোগিতা করে।’
রিয়েল টাইমের সঙ্গে আপনারা সিন্ডিকেট করে কাজ করতে চান এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে বাশার বলেন, ‘আমরা রিয়েল টাইম বা অন্য কিছু বুঝি না। মালয়েশিয়া সরকার যাকে অনুমতি দেবে তার সঙ্গেই আমরা কাজ করব।’
মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী আমিন নূরের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে ১০ জন মিলে মালয়েশিয়ার ব্যবসা করার অভিযোগ অস্বীকার করে রুহুল আমিন স্বপন বলেন, ‘এরকম কোনো প্রস্তাব প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ে আমরা দেইনি। বায়রা প্রেসিডেন্টের এ ধরনের বক্তব্য একেবারেই বেঠিক। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এখনো এমওইউ (সমঝোতা) স্বাক্ষরও হয়নি। ওয়ার্কিং কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর হবে। তার আগেই আমরা কেমন করে এ ধরনের প্রস্তাব আমরা দেব। এটা দেইনি।’
তিনি উল্টো বলেন, ‘বরং তারা (বায়রা প্রেসিডেন্ট) মালয়েশিয়ার একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দাতো আবু হানিফকে (রিয়েল টাইম) বাংলাদেশী কর্মীদের ডাটা সংরক্ষণের (সফটওয়্যার) কাজ পেয়ে দিতে কাজ করছেন।’ আবু হানিফ আবার সিমপ্লেক্স ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স-১০২২) নামে একটি রিক্রটিং এজেন্সিরও মালিক। রিয়েল টাইমের জম্ম হয়েছে গত মার্চ মাসে, যাদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের পক্ষে (রিয়েল টাইম) বায়রা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। মানুষ এতে করাপশন ও সিন্ডিকেটের গন্ধ পাবে।
তবে আবুল বাশার ও রুহুল আমিন স্বপন বলেন, ‘রিয়েল টাইম বা বেস্টিনেট বুঝি না। সরকার যে কোম্পানিকে ভাল মনে করবে তার পক্ষেই কাজ করব।’
মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে আগেই টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গে তারা বলেন, ‘অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু, সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না।’
মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী দুটি কোম্পানি বাংলাদেশে সফরে এসে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা নিতে দেন দরবার করছে- এ অভিযোগ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার দুপুরে তার দফতরে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নো বডি ক্যান বাই মি (আমাকে কেউ কিনতে পারবে না)।’
অন্যদিকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে আগাম অর্থ নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ম্যাকানিজম (প্রক্রিয়া) এখনও ফাইনাল হয়নি। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশবাসীকে অনুরোধ করব, এর আগেই অগ্রিম কারো সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করবেন না। ’
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পযন্ত ঢাকায় সফররত মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) মুস্তফা বিন ইব্রাহিমের নেতৃত্বে কারিগরি প্রতিনিধি দল প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রণালয়ের সচিব খোন্দকার ইফতেখার হায়দারের নেতৃত্ব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি দল।দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই