মানুষের মগজখোকো আদিবাসীদের অদ্ভূত রোগ কুরু

গরুর একটি ভয়ানক রোগ ‘ম্যাড কাউ’। রোগটি গরুর হলেও মানব দেহে সংক্রমিত হয়ে এটি ধ্বংস করে দিতে পারে মানব সমাজকেও। এখন পর্যন্ত এ রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে চিকিৎসকদের ধারণা, এ রোগের চিকিৎসায় কাজে আসতে পারে মানুষের মস্তিষ্কখেকো একটি উপজাতি সম্প্রদায়।

মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে এরকম বিবরণ পাওয়া যায় অনেক দেশের অনেক উপকথায়ই। প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি মানুষ মানুষকে খায়, না কি এসবই লেখকদের বানানো কল্পনা। মানুষ খাওয়ার সত্যিকার প্রমাণ আছে কি না? আর খেলে কারা খায়? কেনইবা খায়?

গল্প কাহিনীতে যেমনই লাগুক পাপুয়া নিউগিনির দক্ষিণ ফোর এলাকার লোকেরা পঞ্চশের দশকেও মানুষের মগজ খেতো। অস্ট্রেলিয়ার সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণার আগ পর্যন্ত ওরা ওদের মৃত আত্মীয়দের মগজ খেতো। অনেক সময় আশপাশের গোষ্ঠির সাথে যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যারা মারা যেত বা বন্দী হতো তাদেরকে খাওয়ার প্রথা ছিল।

ষাটের দশকে পাপুয়া নিউগিনির এসব লোকদের মধ্যে ‘কুরু’ (laughing sickness) নামের একটি রোগ ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। এ রোগ হলে আক্রান্তদের প্রথমে নড়াচড়া ও কথা বলায় সমস্যা হতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা হাঁটা চলার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলে এবং শেষে মারা যায়।

রোগটার কারণ ঠিক পরিষ্কার ছিল না। তবে বোঝা যাচ্ছিল, যেসব এলাকায় মানুষখেকো প্রথা আছে সেসব এলাকায় রোগের প্রকোপ বেশি। আর তাই সত্তরের দশকে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলীয় সরকার মানুষ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। এর পরপরই রোগের প্রকোপ বন্ধ হয়ে যায়।

এবারও বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে একই তথ্য। ম্যাড কাউ রোগের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের গবেষক ডা. সিমন খুঁজে পেয়েছেন, ম্যাড কাউ এবং নিউগিনির কুরু রোগের লক্ষণ এবং পরিণতিতে মিল আছে। তার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ম্যাড কাউ রোগাক্রান্ত গরুর মস্তিষ্ক খেলেই ছড়ায় রোগটি।

রোগটির চিকিৎসাও খুঁজে পেয়েছেন তিনি। পাপুয়া নিউগিনিতে যখন মানুষখেকো প্রথা ছিল তখন যারা কুরু রোগে আক্রান্ত মানুষ খাওয়ার পরও আক্রান্ত হয় নি এবং এখনো বেঁচে আছে, তাদের জিন পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের জিনের মধ্যে ম্যাড কাউ রোগের প্রতিষেধক আছে। মানুষ খাওয়ার কারণেই তাদের মধ্যে এই জিনটি তৈরি হয়েছে।

মজার বিষয় হচ্ছে, শুধু তাদের মধ্যেই নয়, পৃথিবীর সব মানুষের জিনেই এর অস্তিত্ব আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নিউগিনিতে যারা মানুষ খায় তাদের না হয় এসব জিনের দরকার আছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী আমাদের সবার মধ্যে এই জিনের উপস্থিতি কেন? আমরা তো মানুষ খাই না। যেসব জিন ব্যবহার হয় না তারা সাধারণভাবে সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায়। এ গবেষণাটি করতে গিয়েই বেরিয়ে এসেছে আরো অদ্ভূত একটি তথ্য।

আমাদের মধ্যে কেন ম্যাড কাউ প্রতিরোধকারী জিন- বিষয়টি গবেষণা করতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো পৃথিবীতে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে (কেবল জাপানীরা ছাড়া, তাদের অন্য জিন আছে) সবার মধ্যে কুরু জাতীয় রোগ প্রতিরোধকারী জিনের উপস্থিতির কারণ হতে পারে যে আমাদের পুর্বপুরুষরা নিকট অতীতেও (১৫ হাজার বছর আগে) মানুষের মাংস খেতো।

মানুষ খাওয়ার চর্চা আমাদের মধ্যেও ভালোভাবেই ছিল। যদিও এখন মেনে নিতে কষ্ট হয়। আসলে আমাদের ভেতরের মানুষখোকো মানুষটা এখনো ঠিক মরে যায় নি। সংষ্কার আর সভ্যতার চাপে হয়তো আপাতত লুকিয়ে আছে। তো মানুষ খেকো মানুষ কারা? এক অর্থে সুযোগ পেলে আমরা সবাই।



মন্তব্য চালু নেই