মাত্র দুজনেই বদলে দিচ্ছেন চিরচেনা শাহজালাল!

যাত্রী হয়রানি আর ‍দুর্ভোগ ছিল নিত্যসঙ্গী। ব্যাগেজ কাটাছেঁড়া, ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়, আর কথায় কথায় টাকা নেওয়া পরিণত হয়েছিলো অলিখিত নিয়ম-রীতিতে। মাত্র দুজন মানুষের উদ্যোমী প্রচেষ্টায় নিত্যদিনের এসব অনিয়ম-অভিযোগ থেকে ক্রমেই বেরিয়ে আসছে দেশের প্রধান বিমানবন্দর।

এর‍া হলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন ও মুহাম্মদ ইউসুফ। তদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে যাত্রীদের মাঝে নেমে আসতে শুরু করেছে স্বস্তি। তাদের অক্লান্ত শ্রমে ক্রমেই নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হচ্ছে বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট।

ব্যাগেজের মূল্যবান মালামাল খোয়া যাওয়া থেকে শুরু করে উড়োজাহাজের তেল চুরি হতো হররোজ। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টাচ্ছে। যাত্রী হয়রানির দায়ে শাস্তি পেয়ে যাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সও। মোটা অংকের জরিমানা হচ্ছে কর্মীদের, পাচ্ছে কারাদণ্ড। প্রতিদিন পিলে চমকানো নতুন নতুন অপরাধ উদঘাটন আর অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে নিশ্চিত করা হচ্ছে যাত্রী সুরক্ষা। যে কারণে যাত্রী বা ভুক্তভোগীদের আস্থার স্থলে পরিণত হয়েছে বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট।

কিন্তু কিভাবে মাত্র দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে দিনে রাতে পালাক্রমে এত বড় বিমানবন্দরের চিরচেনা চেহারা বদলে দেয়া সম্ভব?

সেই রহস্য জানতেই মুখোমুখি হয় বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মো. ফরহাদ হোসেনের। নিজ কার্যালয়ে বসেই মনিটরিং করছিলেন বিমানবন্দরের সদর-অন্দরের সবকিছু। র্রাব ১০ ছেড়ে ২০১৪ সালের ৬ জুন বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর দায়িত্বে আসেন বিসিএস ২১ ব্যাচের উদ্যোমী কর্মকর্তা শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন।

তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, এসেই দেখি হরিবল অবস্থা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয়, যেন অপরাধীদের হাট-বাজার। যাত্রী হয়রানি, চুরি, অনিয়ম, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। চারপাশে দালাল আর দালাল। এছাড়াও ভিক্ষুক, ভবঘুরে পার্টির দৌরাত্ম্যও ছিলো চরমে। আরেকটা গ্রুপ ছিলো ডলার বেচাকেনার নামে মানুষ ঠকাতো। সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে গছিয়ে দিতো জাল ডলার। নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছেই তাকে বিপাকে পড়তে হতো। অভিযোগ দেবারও উপায় থাকতো না।

নিয়ম কানুনের বালাই ছিলো না। রেন্ট এ কারের নামে অবৈধভাবে পার্কিং এ থাকতো ৪শ’-৫শ’ গাড়ি। চারটি কোম্পানির সাতটি কাউন্টার। ধরেন একজন যাত্রীর তিনটি লাগেজ। দেখা গেলো-টানাটানি করে পৃথক তিনটি গাড়িতেই তোলা হয়েছে তিনটি লাগেজ। আবার যাত্রীদের নিয়ে টানাটানি ছাড়াও বাস কন্ডাকটরদের মতো গুলিস্তান- গাবতলি বলে শোরগোল। আমরা এখানে নজর দিয়েছি। বলেছি-এভাবে চলবে না। সবাইকে নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করতে হবে।

বিমানবন্দরে নেমেই দেখলেন- নিজে এসেছেন তো ব্যাগেজ আসেনি। আর এলেও কাটাছেঁড়া। এ সবের কোন প্রতিকার পেতো না কেউ। ছিলো না জবাবদিহিতাও। এসব তো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে যায় না। যেতে দেয়াও সমীচিন না। তাই শুরু হলো শুদ্ধি অভিযান।

একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমার সাথে যোগ দিলেন ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইউসুফ। শুরু হলো যাত্রীদের নিত্য দুর্ভোগ, হয়রানি, সমস্যা ও দুর্নীতির সাথে কারা জড়িত, তাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা।

দেখা গেলো, প্রচলিত রীতিনীতি আর আইন-কানুনের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ব্যবধান।

প্রথমত যাত্রীরাও যেমন তাদের অধিকারের বিষয়ে অজ্ঞ, তেমনি সেবাদাতারাও এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন। এভিয়েশন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন আর রীতিনীতি সম্পর্কে নেয়া হলো খোঁজ-খবর। রীতিমতো স্টাডি শুরু করলাম। যাত্রীদের অধিকার এবং এয়ারলাইন্স ও এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিলাম নিজেরা। তারপর যাত্রীদের সচেতনতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে সরাসরি সেবা গ্রহিতাদের সাথে শুরু হলো নিবিড় যোগাযোগ। আসতে শুরু করলো নানা অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র। পাশাপাশি তার সমাধান যাত্রা।

শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, বিমানবন্দর ঘিরে দালাল, হকার, জাল ডলার ব্যবসায়ী, চোর, প্রতারক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শুরু হলো অভিযান। আমাদের লক্ষ্য ছিলো, এসব অভিযোগের মাত্রাকে সহনীয় সীমায় নিয়ে আসা। আর সেই লক্ষ্য পূরণই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রতিদিন এই বিমানবন্দর দিয়ে উঠানামা করে ১’শ৩০টি ফ্লাইট। ২৭টি বিদেশি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সামান্য জনবলে পুরোপুরি যাত্রীদের স্বার্থ সুরক্ষা করাটাও একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা পালাক্রমে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সামাল দিই গোটা বিমানবন্দর। এই কার্যালয়ে মাত্র ৫ জনের টিম দিয়ে দায়িত্ব পালন করাটাও কম কথা নয়। এদের মধ্য দুজন পিয়ন, একজন উচ্চমান সহকারী। অপর দু’জন সহকারী। তবে জনবল বাড়লে সেবার বিস্তৃতি বাড়বে।- যোগ করেন শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন।

কথা হয়, এয়ারলাইন্স অপারেটিং কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি ও মালদোভিয়ান এয়ারলাইন্সের ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজার রেহনুমা শেখের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি জানান, চেষ্টা আর সততা থাকলে অসাধ্যকে যে সাধ্য করা যায়, তার প্রমাণ বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মো. ফরহাদ হোসেন ও মুহাম্মদ ইউসুফ এখন অপরাধীদের কাছে যেমন আতংক, তেমনি স্বস্তি আর আস্থার ঠিকানা প্লেনযাত্রীদের কাছে।

এখন আইনের সঠিক প্রয়োগের কারণে এয়ারলাইন্সগুলোও যাত্রীসেবায় আরো যত্নবান আর আন্তরিক হয়ে উঠেছে।

ফরহাদ হোসেন বলেন, আমরা বলবো না সব অপরাধীকে জেলে পাঠাতে পেরেছি বা সব অপরাধ বা হয়রানি নির্মূল করা গেছে। কিন্তু আমরা যে প্রক্রিয়া শুরু করেছি তার ফল যাত্রীরা পেতে শুরু করেছেন।

আগে নিরীহ যাত্রীদের ডেকে বলা হতো, আপনার ব্যাগেজে নাম লেখা নেই। নাম লেখার কথা বলে নেয়া হতো ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। প্রবেশ পথেও নেয়া হতো টাকা।

আবার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ বা ব্যাংকের বুথ থেকেও ডলার-রিয়েল বলে ডাকাডাকি করা হতো। নিয়ম নীতির বাইরে উচ্চ ম‍ূল্যে ডলার বেচাকেনা হতো। কাউকে ঠকানো হতো, মুদ্রা রূপান্তরের পর কোন রশিদ দেয়া হতো না।

এ ছাড়াও এম্বারকেশন কার্ড পূরণে অক্ষম ব্যক্তিদের ফর্ম পূরণের নাম করেও নেয়া হতো টাকা। এখন তো ডিজিটাল ব্যবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে এসব উঠে গেছে। অথচ আমাদের দেশে রয়ে গেলো।

কিন্তু পরিসংখ্যান তো বলছে, বিশ্বের ১০টি নিকৃষ্টতম বিমানবন্দরের তালিকায় অন্যতম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দ্রুত এই বদনাম ঘোচানোর উপায় কি?

উত্তরে ফরহাদ হোসেন বলেন, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।মানুষ এখন আগের চেয়ে আরো বেশি সচেতন। আমরা যে কর্মপরিকল্পনায় অগ্রসর হচ্ছি, তাতে এ বিমানবন্দরকে শতভাগ যাত্রীবান্ধব আর বিমানবন্দরের মানসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করা অসাধ্য নয়। ‘বি’ থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত করতে শুধু আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা আর সমন্বয়ই যথেষ্ট।



মন্তব্য চালু নেই