মহিলাদের সামনেও নেকাব পরত জঙ্গি নারী

সিলেটের আতিয়া মহলে বাসা ভাড়া নেয়ার পর থেকেই জঙ্গিদের চালচলন ছিল রহস্যজনক। চার তলার একটি পরিবার ছাড়া আর কোনো ভাড়াটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তাদের। ছিল না কোনো মেলামেশা। ফলে ঠিকমতো তাদের মুখ দেখার সুযোগ পাননি আশপাশের অন্য ভাড়াটেরা। তবে পাঁচ তলা আতিয়া মহলের সবকিছুই জানেন ভবনের তত্ত্বাবধায়ক। যিনি সবার কাছে ‘রুজিনার মা’ হিসেবে পরিচিত। জঙ্গি পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। প্রায় সময়ই বসে থাকতেন রহস্যময় পরিবারটির কক্ষে।খবর যুগান্তরের।

ভাড়াটেদের দাবি, রুজিনার মা সব জানে। তবে ঘটনার পর থেকে রুজিনার মাকে আড়ালে রাখা হয়েছে। বাসার মালিক উস্তার আলীও এড়িয়ে যাচ্ছেন সাক্ষাৎপ্রার্থীদের। ফোনেও কোনো কথা বলছেন না। ভবনের ভাড়াটেরা জানান, বাসার বাইরে বের হলেও আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা থাকত নারী জঙ্গির। এমনকি পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাদের সঙ্গেও নারী জঙ্গি কথা বলতেন নেকাবে চোখ-মুখ ঢেকে। তাদের এমন চালচলনে অন্য ভাড়াটেদের নানা সন্দেহ জাগত। প্রশ্ন জাগত এরা কারা? তাছাড়া তাদের চলাফেরায় কখনোই ধীরগতি ছিল না। দ্রুতগতিতে বাসা থেকে বের হতো। আবার বাসায় ঢুকত দ্রুতগতিতে। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাছ, শাক-সবজি কেনার সময় মোটেও দরকষাকষি করত না। যা দাম চাইত তা দিয়েই পণ্য কিনে দ্রুত বাসায় ঢুকে পড়ত জঙ্গি নারী। বাজারহাট বা পারিবারিক অন্য কোনো কাজে বাসার পুরুষটির বদলে নারী জঙ্গিকেই বেশি দেখা যেত। বাসার বাইরে বেরোলে তার পুরো শরীর থাকত বোরকায় ঢাকা। চলাফেরায় এমন অস্বাভাবিকতার পাশপাশি তাদের বাসার দরজা-জানালা প্রায়ই বন্ধ থাকত। কখনো জানালা, দরজা খোলা হলেও টানানো থাকত পর্দা। ফলে বাইরে থেকে বাসার ভেতরের দৃশ্য কখনোই দেখা যেত না। রহস্যময় এ পরিবারের পুরুষ সদস্য একটি কোম্পানিতে চাকরি করে বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কোনোদিন অফিস টাইমে তাকে বাসা থেকে বাইরে যেতে দেখা যায়নি। অফিস শেষে বিকাল বা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেও আশপাশের ভাড়াটেরা দেখেননি। ফলে পুরুষটি বাসার ভেতরে না বাইরে অবস্থান করত তা কেউ বলতে পারছেন না।

আতিয়া মহলের ভাড়াটেদের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, আতিয়া মহলের নিচ তলার প্রধান ফটকের বাসাটি খালি ছিল। ওই বাসার জন্য ভাড়াটে খোঁজা হচ্ছিল। একপর্যায়ে রহস্যময় পরিবারটি বাসা ভাড়া নিতে আসে। তারা ভবনের প্রবেশ মুখে থাকা বাসাটি ভাড়া নিতে রাজি হয়নি। তাদের পছন্দ ভবনের শেষ প্রান্তে থাকা বাসাটি। তাদের দাবির মুখে ভবনের মালিক উস্তার আলী শেষ প্রান্তের ভাড়াটেদের সামনের খালি বাসায় নিয়ে আসেন। নবাগত ভাড়াটেদের ঠাঁই দেন ভবনের শেষ প্রান্তে। নবাগত ভাড়াটের পছন্দ করা ভেতরের বাসাটির চারদিকে খোলা জায়গা রয়েছে। সুযোগ রয়েছে ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ না করেও বাইরের খোলা জায়গা দিয়ে এসে বাসার ভাড়াটেদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার।

আতিয়া মহলের ভাড়াটিয়া হুসনে জাহান বলেন, আমার আম্মা সেদিন মাছ কিনছিলেন। অন্যান্য ক্রেতারা তখন মাছের দাম নিয়ে দরকষাকষি করছিলেন। এ সময় রহস্যময় ওই নারী আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে ওখানে আসেন। তিনি হুট করে এসে দাম যা চাইল তা দিয়ে মাছ কিনে নিয়ে চলে যান। কোনো দরদাম করেননি। তাদের বাসার দরজা-জানালায় থাকত পর্দা টানানো।

হুসনে জাহান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। আজ শুরু হচ্ছে তার পরীক্ষা। কিন্তু তার প্রবেশপত্র আটকা ছিল আতিয়া মহলে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। পরে শনিবার পুলিশের সহযোগিতায় প্রবেশপত্রটি বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। হুসনে জাহান জানান, ২৪ মার্চ তাদের ঘুম ভাঙে বোমার শব্দে। আতিয়া মহলেই এ বিস্ফোরণ ঘটে। ঘুম থেকে উঠে দেখেন বাসার চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। এরপর আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের বাসা থেকে উদ্ধার করে।

আতিয়া মহলে ভাড়াটে ছিলেন তানিয়া আজমীন। স্বামী বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী। তানিয়া বলেন, আতিয়া মহল থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে আসার পর এখন কেউ বাসা ভাড়া দিচ্ছে না। ফলে এখানে-ওখানে হোটেলে কয়েক রাত কেটেছে। আমার স্বামীর মালিকের সহযোগিতায় তিন সন্তানসহ একটি স্টোর রুমে আশ্রয় নিয়েছি। এখনও চরম দুর্ভোগের মধ্যে আছি। বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে টেনশনে আছি। তিনি জানান, রুজিনার মা আতিয়া মহলের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। প্রায় সময়ই ওই (জঙ্গি) বাসায় তিনি যাওয়া-আসা করতেন। তিনি অনেক কিছুই জানবেন।

এদিকে আতিয়া মহলের রহস্যময় ভাড়াটে ও জঙ্গি আস্তানার ব্যাপারে কথা বলতে বাড়ির মালিক উস্তার আলীকে অসংখ্যবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। যদিও তার ফোনটি কিছুক্ষণ পরপর ব্যস্ত পাওয়া গেছে। এর আগে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শুক্রবার তিনি জানিয়েছিলেন শরীর খারাপ। একপর্যায়ে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নম্বর দেয়ার কথা বলে ফোন কেটে দেন। এরপর থেকে আর ফোন ধরছেন না উস্তার আলী।

অপরদিকে জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে নিহত দুই জঙ্গির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার বিকালে বেওয়ারিশ হিসেবে নগরীর হযরত মানিকপীর (রহ.) কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। ২৪ মার্চ আতিয়া মহলে শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান অপারেশন টোয়াইলাইট।

ফেব্রুয়ারিতে আতিয়া মহলে কাওছার ও মর্জিনা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গিরা। কাওছার নিজেকে পরিচয় দেয় ‘প্রাণ কোম্পানির কর্মকর্তা’। অন্যদিকে চার তলায় বসবাসকারী পরিবারটি কবে বাসা ভাড়া নেয় সে তথ্য জানা যায়নি। ধারণা করা ওই পরিবারটিও জঙ্গি। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় জঙ্গি আটকের পর তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। ঢাকা থেকে ছুটে আসেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা। সিলেটের পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঘেরাও দেন আতিয়া মহল। এরপর পর্যায়ক্রমে পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত ও সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোদের অভিযান চলে আতিয়া মহলে। এতে নিহত হয় ৪ জঙ্গি। উদ্ধার দুই জঙ্গির লাশের মধ্যে একটি পুরুষের ও অপরটি নারীর, এরা ভবনের শেষ প্রান্তের বাসার রহস্যময় সেই নারী-পুরুষ। লাশ দুটি শনাক্ত করতে ইতিমধ্যে নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি মুসা ও আলোচিত নারী জঙ্গি মর্জিনার পরিবারকে সিলেট নিয়ে আসা হয়। তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় ডিএনএ। আতিয়া মহলের ভেতরে এখনও বিস্ফোরক রয়েছে। এরমধ্যে পড়ে রয়েছে দুই জঙ্গির লাশ। ভবনের ভাড়াটিয়ারা ধারণা করছেন, এ দুই জঙ্গি ৪ তলার পরিবারটি।



মন্তব্য চালু নেই