ভাষা মতিনের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন বৃহষ্পতিবার

মহান ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তী

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেই সমাবেশের অন্যতম বক্তা ছিলেন আব্দুল মতিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি ছিলেন আহ্বায়ক। ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য পরবর্তীকালে তার নামের আগে ‘ভাষা’ শব্দটি যোগ হয়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সফল হলেও পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল আব্দুল মতিনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে তিন বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়েছিল। একাধিকবার তাকে কারাবরণ করতে হয়। হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে থাকতে হয় মাসের পর মাস।
পরবর্তী জীবনে ভাষা মতিন জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। পেয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সংস্পর্শ। ভাষা মতিনের ঘরের দেয়ালে নিজের একটি পোট্রেটের পাশাপাশি টানানো আছে মওলানা ভাসানীর ছবি। তাকেই রাজনৈতিক দর্শনের আদর্শ মনে করতেন।
ভাসানীর গড়া জাতীয় কৃষক সমিতির ফুলটাইম কর্মী হিসেবে তিনি এক সময় কাজ করতেন। পরবর্তীতে যোগ দেন ওয়ার্কার্স পার্টিতে। ১৯৯৭-এ হার্টব্লক হওয়ার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। হার্টে বাইপাস সার্জারির পর থেকে বেছে নেন অবসর জীবন। বইপড়া আর লেখালেখির মধ্যে আব্দুল মতিন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। তার ঘর জুড়ে ছিল বই আর বই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন সভায় ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান’ এ কথা শুনে যিনি মুখোমুখি প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছিলেন তিনি- আব্দুল মতিন। সমাবর্তন সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন নব্য স্বাধীন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে তখন বুদ্ধিজীবী মহলে চলছিল তুমুল বাকবিতণ্ডা।
১৯৪৮ এর মার্চে জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির অনুকরণে পাকিস্তানে প্রবর্তন করতে চাইলেন উর্দু ভাষা। কিন্তু পূর্ববঙ্গের বাঙালীর কাছে এ সিদ্ধান্ত ছিল বিষময়। সে সময় জিন্নাহর ন্যায় একজন নেতার সামনে সত্য প্রকাশ ও সকলকে প্রতিবাদ জানাতে সাহসী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন অকুতোভয় যুবক আব্দুল মতিন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
ছাত্র জীবন শেষে রাজনীতির সংস্পর্শে এসে জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ‘কমরেড মতিন’ ‘ভাষা মতিন’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও নিজ এলাকায় তিনি ‘ছাত্র মতিন’ হিসেবেই পরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন। অকুতোভয় এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার যমুনার তীরবর্তী চর এলাকা ধুবালিয়া গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবা আব্দুল জলিল দার্জিলিংয়ে চা বাগানে উচ্চ বেতনে চাকরি করতেন। সে সুবাদেই কিশোর বয়স পর্যন্ত তিনি দার্জিলিংয়ে শিক্ষা জীবন কাটান। ১৯৩২ সালে দার্জিলিং মহারানী গার্লস হাইস্কুলে পড়াকালীন তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। এ সময়ে আব্দুল মতিন ও সহোদর ভাই-বোনদের প্রতিপালন করার জন্য তার বাবা একজন ইংরেজ মহিলা গভর্নেন্স নিয়োগ করেন।
আব্দুল মতিন ১৯৪৩ সালে দার্জিলিং সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৫ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার জন্য গ্রেপ্তার হন এবং মুচলেকা না দেয়ায় পাক সরকার তাকে সুপিরিয়র সার্ভিসের মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। দুই মাস পর কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর মুচলেকা না দেয়ায় তাকে তিন বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।
১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫২ এর ৭ মার্চে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এক বছর কারাবরণের পর পুনরায় ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন আব্দুল মতিন।
১৯৫৪ সালে কৃষক আন্দোলনে যোগদান, ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে থাকার সময় ১৯৫৮ সালে আইয়ুব সরকার হুলিয়া জারি এবং গোপন কার্যক্রম চালানোয় ১৯৬১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দু’বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেন তিনি।
১৯৬৯ এর গণ অভ্যূত্থানকালে সংগ্রামী কৃষকদের সংগঠিত করে লাল টুপি বাহিনী গঠন করে মওলানা ভাসানীর ডাকে পাকশীর শাহপুরে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সময় একজন সংগ্রামী নেতা হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে।
১৯৭০ এ ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করলে আব্দুল মতিন ভারতের সিপিআই (এমএল) নেতা চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের অনুকরণে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ কায়েমের আওয়াজ তোলেন এবং তার অনুসারী কর্মীদের নিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) গড়ে তোলেন। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার বাহিনীর হাতে তার বাবা নিহত হন।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর পতন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ভাষা মতিন ও তার নেতৃত্বাধীন পার্টি চীনা বিপ্লবের অনুকরণে রাজশাহীর আত্রাই এলাকাকে মুক্ত এলাকা ঘোষণা করে। ফলে মুজিব বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাদের ভয়াবহ সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। এতে তাদের অনেক কর্মী প্রাণ হারায় ও আব্দুল মতিন আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন।
১৯৭৭ সালে কারামুক্তির পর পুণরায় প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে প্রথমে কমিউনিস্ট লীগ গঠন করেন। ওয়ার্কার্স পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পলিট ব্যুরো সদস্য ও জাতীয় কৃষক সমিতির সদস্য হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ী ও বয়োবৃদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিপীড়িত শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির স্বপ্ন দেখতে এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে কাজ করে গেছেন।
ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ৩৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ঈশ্বরদীর মেয়ে গুলবদন নেসা মনিকাকে। সেই থেকে সুখে-দুঃখে তারা দু’জন এক সঙ্গেই ছিলেন। তাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মাতিয়া বানু শুকু চারুকলা থেকে ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে ছোট পর্দার জন্য নাটক তৈরি করছেন। ছোট মেয়ে মালিহা বানু শোভা একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
আজীবন সংগ্রামী ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল মতিন চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে।

ভাষা মতিনের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন বৃহষ্পতিবার:
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সৈনিক আব্দুল মতিনের মরদেহে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে বলে তার পারিবারিক সূত্রে এ জানা গেছে।
বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আফজাল হোসেন জানান, গত ৪ অক্টোবর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো। বুধবার সকাল ৯টার দিকে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়।
এদিকে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন মৃত্যুর আগেই শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালকে মরণোত্তর দেহ দান করার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। আর চক্ষু দান করার ঘোষণা দিয়েছেন সন্ধানীকে। ওই ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার আব্দুল মতিনের মৃত্যুর পর তার কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়। আর তার মরদেহ রাখা হয়েছে (ঢামেক) হাসপাতালের হিমঘরে।
উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন ভাষা সংগ্রামের অন্যমত সৈনিক আব্দুল মতিন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে নগরীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন ১৯ আগস্ট তাকে বিএসএমএমইউতে আনা হয়। শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে চলতি মাসের ৪ তারিখে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় তাকে।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ও সংগ্রামী আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলায় এক কৃষক পরিবারে।



মন্তব্য চালু নেই