মঞ্চ প্রস্তুত : নিজামীর ফাঁসি নিয়ে তোড়জোড়

যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডিত জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করতে কোনোরকম কালক্ষেপণ করতে চায় না সরকার। তাই আইনি প্রক্রিয়া মেনে যত দ্রুত তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো যায় তার তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনসহ দু’ধাপ আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকলেও এরই মধ্যে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতসহ আনুষঙ্গিক বেশকিছু কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি জল্লাদ নির্ধারণ পর্বও চূড়ান্ত করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জেলকোডের ৯৯১ বিধি অনুসারে ৭ বা ২১ দিনে দন্ড কার্যকরের নিয়ম মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তাই তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে দিন নয়, ক্ষণ গণনা চলছে।

সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাষ্য, এ ইস্যুতে জামায়াত-শিবির হরতালসহ নানা আন্দোলন কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মৌলবাদী জঙ্গিদেরও তারা এ দলে ভিড়িয়েছে। আর এ সুযোগে দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পাঁয়তারা করছে। তবে ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেলে তা সব থেমে যাবে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকরের ঘটনাগুলো থেকে সে প্রমাণই মিলেছে। তাই এ ব্যাপারে কালবিলম্ব করে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার। এ ছাড়াও নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের ইস্যুতে সারাদেশে জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করাও অনেকটা দুরূহ বলে মন্তব্য করেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা।

এদিকে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক শীর্ষ নেতার দাবি, শুধু সরকারই নয়, দেশের ১৬ কোটি মানুষই মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার পক্ষে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লাখো মানুষ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এমনকি ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবিতে দেশের বিভিন্নস্থানে মিছিলও হয়েছে।

অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কীভাবে দন্ড কার্যকর হবে, তা মতিউর রহমান নিজামীর পুনর্বিবেচনার আবেদনের রায়ে বিস্তারিত বলা আছে। আপিল বিভাগের ওই রায় অনুসারে আদালতের আদেশ পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষকে আসামির সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ দিতে হবে। আর কারা কর্তৃপক্ষ আসামির কাছে জানতে চাইবে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করবেন কি না। যদি আসামি ক্ষমার আবেদন করতে না চান, তবে কারা কর্তৃপক্ষের উচিত দেরি না করে দন্ড কার্যকর করা।

এদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এ ফাঁসির সেলে মতিউর রহমান নিজামী বন্দি আছেন। সেখানে আট ফুট দৈর্ঘ্য আর সাড়ে চার ফুট প্রস্থের ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। জল্লাদ হিসেবে নির্বাচিতদেরও এ কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন শুধু বিচারপতিদের স্বাক্ষর করা একটি আদেশ কারাগারে যাওয়ার অপেক্ষা। তবে এর মধ্যে মার্সি পিটিশন করা হলে এবং রাষ্ট্রপতি তাতে সাড়া দিলে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে।

সুপ্রিমকোর্ট সূত্র জানায়, রেজিস্ট্রার কারা কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে রায়ের বিষয়টি জানাতে পারেন। অথবা আদালত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করলে তা নিয়ম অনুযায়ী কারাগারে চলে যাবে। কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজ হয়েছিল। এর এক বছর পর রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া গেছে। কিন্তু রায় ঘোষণার পর সেদিনই একটি ‘শর্ট অর্ডার’ দেয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ রিভিউ পিটিশন খারিজ হওয়ার ব্যাপারে একটি ইনটিমেশন (অবহিতকরণ) চায়।

এর আগে যুদ্ধাপরাধ মামলার চার আসামির দন্ড কার্যকরের নজির থেকে দেখা গেছে, লিখিত রায় পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আসামিকে তা পড়ে শোনায়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না।
অবশ্য যুদ্ধাপরাধ আইনে দন্ডিতরা অন্য মামলার আসামিদের মতো প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে নির্ধারিত সাতদিন সময় পাবেন না। তবে সিদ্ধান্ত জানাতে তারা কতদিন সময় পাবেন, সে বিষয়েও আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।
এর আগে আরেক জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য আসামি ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। আর যৌক্তিক সময়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, একটি দরখাস্ত লিখতে যে সময় লাগে- ‘যৌক্তিক সময়’ তার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়।

আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনরা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন।

দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নিজামীর ফাঁসি কার্যকর ইস্যুতে দেশজুড়ে তা-ব বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও সরকারের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। কেননা, জামায়াত-শিবির অতীতে অসংখ্যবার চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে। যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও সম্প্রতিক সময়ে উগ্রপন্থি জঙ্গিদের সোচ্চার হয়ে ওঠার বিষয়টিও সরকার ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছে। এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও নীতি-নির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন। তাই বিগত সময়ের চেয়ে সরকার আরো বেশি সতর্ক রয়েছে।
মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে সারাদেশে র‌্যাব-পুলিশের টহল জোরদার করার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক বিজিবি নামানো হবে। বাড়ানো হবে গোয়েন্দা নজরদারি।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রাখার মাত্র তিনদিনের মাথায় ২১ নভেম্বর মধ্যরাতে তাদের দু’জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করার ৫ দিনের মাথায় তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার মাত্র ১০ ঘণ্টা পরই।

কারা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই চার যুদ্ধাপরাধীর রিভিউ আবেদন খারিজ করার পর যতটুকু সময় দেয়া হয়েছে, মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ হিসেবে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে।

এদিকে কাশিমপুর কারাগারে নাকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করা হবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি আপাতত গোপন রাখা হচ্ছে। তবে দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে তা মিডিয়াকে জানানো হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র। সুত্র-যায়যায় দিন



মন্তব্য চালু নেই