ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ : অব্যাহতি পেলেন দুদক মহাপরিচালক

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইন বিভাগের মহাপরিচালক কামরুল হোসেন মোল্লা। আর এর মধ্য দিয়ে সরষের ভূত তাড়ানোর উদ্যোগ থেকে সরে আসলো সংস্থাটি। অথচ কমিশনে পেশ করা অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কামরুল হোসেন মোল্লার সনদ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়ার সনদটি ত্রুটিপূর্ণ বলা হলেও, তাকেও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কমিশন সদ্য অবসরে যাওয়া পরিচালক গোলাম ইয়াহিয়া ও উপপরিচালক ঢালি আবদুস সামাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে। তবে অন্য পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারির সনদ সঠিক বলে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘কামরুল হোসেন মোল্লাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবদুল আজিজ ভূঁইয়াকে অব্যহতি দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গোলাম ইয়াহিয়া ও ঢালি আবদুস সামাদের সনদ সঠিক নয়। দুদকের মুক্তিযোদ্ধা মোট ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারির সনদ সর্ম্পকিত প্রতিবেদন শিগগিরই মুক্তিযু্দ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’

২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির ডিজিসহ ৮ কর্মকর্তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগের অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যেখানে অনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার অভিযোগে দুদকের মহাপরিচালক (ডিজি) কামরুল হাসান মোল্লা, পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও উপপরিচালক ঢালী আবুদস সামাদকে দায়ী করা হয়।

অন্যদিকে, অপর পরিচালক গোলাম ইয়াহিয়ার অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর। এরই মধ্যে অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে স্বেচ্ছায় কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছেন ওই পরিচালক।

এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি তাদের নাম ও মুক্তিবার্তা পত্রিকা অনুসারে তাদের ক্রমিং নম্বরগুলো হলো- উপপরিচালক এস এম গোলাম মাওলা সিদ্দিকী (০১১৮০১০২৭৫) ও প্রাক্তন উপপরিচালক রঞ্জন কুমার মজুমদার (০১১৫০২০১১৭), সহকারি পরিদর্শক (পিআরএল ছুটিভোগরত) আবদুস সোবহান (০২১১০৪০১৮৮), কোর্ট সহকারি (এএসআই) নুরুল ইসলাম (০১১৭১৩০০৬০) ও ইসহাক ফকির (০১১৬০৭০০৭৬)।

প্রতিবেদন অনুসারে অনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন এমন কর্মকর্তাদের বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা হলো :

মহাপরিচালক (ডিজি) কামরুল হাসান মোল্লা :

দুদকের এই ডিজির স্কুল সার্টিফিকেট অনুসারে জন্ম-তারিখ দেওয়া রয়েছে ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়েই তার বয়স ছিল ১১ বছর ১১ মাস। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য ১৬ বছর বয়স হওয়ার যে বাধ্যবাধকতা, তা পূরণ করে না। তাছাড়া চাকুরীতে যোগদানের সময়ে দাখিলকৃত কাগজপত্রের কোথাও তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেননি। তার দাবি অনুসারে লাল মুক্তিবার্তায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারতের দেওয়া তালিকায়ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর সরকার কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রেও দুদকের ডিজির নাম অর্ন্তভুক্ত হয়নি। পরবর্তীতে তার নামে পৃথকভাবে ২০১১ সালের ৬ মার্চ গেজেট প্রকাশিত হয়। তবে সেই মুক্তিযোদ্ধা সনদে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষর নেই।

পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া :

মহাপরিচালকের মতো দুদকের এই পরিচালকেরও ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়েই বয়স ছিল ১৩ বছর ৩ মাস। যা জামুকার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য ১৬ বছর বয়সের বাধ্যবাধকতা পূরণ করে না। তাছাড়া চাকুরীতে যোগদানের সময়ে দাখিলকৃত কাগজপত্রের কোথাও তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেননি।
তার বিরুদ্ধে গুরুতর আরো যে অভিযোগ তা হলো, তিনি তার দাখিলকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষর জাল করেছেন। দুদকের অনুসন্ধানেও মিলেছে এ অভিযোগের সত্যতা।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচালক আবদুল আজিজ যে সনদ প্রদর্শন করেন তার ক্রমিক নম্বর- ৪৯৭১৯। অথচ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ইস্যুকৃত সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা সনদের ক্রমিক নম্বর- ৪৭৯৩১। অর্থাৎ তার দাখিলকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিসাক্ষর জাল।

উপপরিচালক ঢালী আবদুস সামাদ :

স্কুল সার্টিফিকেট অনুসারে ঢালী আবদুস সামাদের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি। এই কর্মকর্তার ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে বয়স ছিল ১৫ বছর ১১ মাস। যা জামুকার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য ১৬ বছর বয়সের বাধ্যবাধকতা পূরণ করে না।

এ ছাড়া তার দাখিল করা মুক্তিযোদ্ধা সনদে (মুক্তিবার্তার নম্বর) যে নম্বর দেওয়া রয়েছে দুদকের অনুসন্ধানে তা ভূয়া প্রমাণিত হয়েছে। ২০১০ সালে জামুকা কর্তৃক প্রকাশিত পরিপত্রেও তার নাম পাওয়া যায়নি।

পরিচালক গোলাম ইয়াহিয়া :

সদ্য প্রাক্তন গোলাম ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধেও অনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া এই পরিচালকও চাকুরী গ্রহণকালে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেননি। যার দায় নিয়ে ওই পরিচালক সরকার থেকে নেওয়া বাড়তি অর্থ ইতোমধ্যে কমিশনকে ফেরত দিয়েছেন। ২০১৪ সালের নভেম্বরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিলেও এখন পর্য্ন্ত কমিশন কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, কমিশনের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারির মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির এ অভিযোগ ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর কমিশনের মাসিক সভায় উত্থাপিত হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করে কমিশন এতে অনুমোদন দিলে ২২ অক্টোবর দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধানী টিম গঠন করে অনুসন্ধান শুরু করা হয়।

অনুসন্ধানকালে টিম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অভিযুক্তদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন, নামের সনদ, মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত নাম ও সংশ্লিষ্ট যাবতীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ওই কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সার্ভিস বুকের যাবতীয় তথ্য ও সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।

অনুসন্ধান টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক জুলফিকার আলী। টিমের অন্য সদস্য হলেন, সহকারি পরিচালক এস এম রফিকুল ইসলাম।



মন্তব্য চালু নেই