ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি
ষা আন্দোলন শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ নিজের সংগ্রামী শক্তির প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এ আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির গণদাবি ধীরে ধীরে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে, শহীদ হন অনেকে। সেদিন থেকে ফেব্রুয়ারি মানে ভাষার মাস, ফেব্রুয়ারি মানে রক্ত ঝরানো একুশে ফেব্রুয়ারি।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও আসাম ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য এমন আন্দোলনের নজির নেই। পাকিস্তান আমলের এই আন্দোলনকে সীমিত অর্থে দেখলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এতে বিষয়টি খণ্ডিত হয়ে পড়ে। এটি ক্ষণস্থায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় এ অঞ্চলের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কোনোভাবেই এর থেকে বিচ্যুত করা যায় না। এমনকি উপমহাদেশে বাংলার বিশিষ্টতা একুশে ফেব্রুয়ারির দান।
দু’শ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ- পশ্চিম ও পূর্ব। দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব হাজার মাইলেরও বেশি। দূরত্ব শুধু ভৌগোলিকই ছিল না, দুই ভূগোলের ছিল আলাদা সংস্কৃতি। ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা আসলে মৌলিক পার্থক্যগুলোর প্রকাশ মাত্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই অন্যান্য পার্থক্যগুলো বিকট চেহারা নিয়ে হাজির হবে। যার প্রথম প্রকাশ ভাষা কেন্দ্রিক।
এমন নয় যে, ভাষাকেন্দ্রিক বিতর্ক নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু। বরং, দেশভাগ হওয়ার আগেই ভাষাকেন্দ্রিক বিতর্ক জেগে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ১৯ মে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।’ একই বছরের ২২ ও ২৩ জুন লেখক ও সাংবাদিক আবদুল হক দুই কিস্তির একটি নিবন্ধ লিখেন। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামের ওই লেখায় তিনি বাংলা ভাষা কেন রাষ্ট্রভাষা হবে তার স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
দেশভাগের এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এমন হঠকারী ঘোষণা মেনে নেয়নি পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নানা সংগঠন। আয়োজিত হতে থাকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ। লেখা হয় প্রবন্ধ, কবিতা ও গান। অর্থাৎ, সমাজের সর্বস্তরে ভাষা প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করে।
এর সর্বোচ্চ বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮)। সেদিন সরকারি ১৪৪ ধারা আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহু সংখ্যক ছাত্র, জনতা ও রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলে পুলিশ গুলি করলে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এ ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে মিছিল ও বিক্ষোভ হয়। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দিবসের শুরু হয় খুব সকালে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরির মাধ্যমে। সর্বস্তরের জনগণ শহীদ মিনারে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এ ছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ করা হয়। এ দিনে সরকারি ছুটি থাকে। বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমগুলো বিশেষ আয়োজন করে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী আয়োজিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার দেশের অন্যতম সম্মাননা একুশে পদক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রদান করে।
২০০০ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর থেকে দিনটি বৈশ্বিক পর্যায়ে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে।
মন্তব্য চালু নেই