বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি

ভালোমানুষি কোনো পেশা নয়

নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি হওয়ার ঘটনায় গভর্নর আতিউর রহমানকে অবশেষে পদত্যাগ করতে হলো। অনেক পরে হলেও তিনি পদত্যাগ করেছেন-এটাকে একটা ভালো দৃষ্টান্ত আখ্যা দিয়ে কেউ কেউ তাঁর প্রশংসা করছেন। বলছেন, তিনি একজন ভালো মানুষ, পদত্যাগ করে সৎসাহসের প্রমাণ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, না শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চাকরি রক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তা সরকার ও রাজনীতির অন্দরমহলের মানুষেরা জানেন। আমাদের জন্য সেসব জানা খুব জরুরি নয়। কারণ, তিনি ভালো মানুষ না মন্দ মানুষ এই বিবেচনা অপ্রাসঙ্গিক। তিনি কতটা রবীন্দ্রভক্ত, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কতগুলো বই লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কতটা অনুগ্রহভাজন কিংবা তিনি শৈশবে কতটা দরিদ্র ছিলেন, কত কষ্টে লেখাপড়া করেছেন-এসব আলাপ নিষ্প্রয়োজনীয়। আমাদের প্রয়োজন পেশাদারি দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে গভর্নর আতিউর রহমানের অবস্থা বিচার করে দেখা।

প্রথমত, পৃথিবীর ২৫০টা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট আছে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকই একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে গেল। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুতর বিষয়। কেন শুধু আমাদের টাকাই চুরি হলো?
দ্বিতীয়ত, কীভাবে টাকাটা চুরি হলো? কী প্রক্রিয়ায়? বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেন, হ্যাকার বা সাইবার অপরাধীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে ফেডের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কেউ সহযোগিতা না করলে বাইরের হ্যাকারদের পক্ষে এটা করা অসম্ভব। আবার বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মত, আদৌ কোনো হ্যাকিং হয়নি। এটা স্রেফ চুরি, যা করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসের ভেতর থেকে, ভেতরের লোকজনের হাতেই, যাঁরা কাজটা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহার করেই। এই পক্ষের মত, ফেডের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের লেনদেন যে প্রযুক্তির সাহায্যে হয়, তা ইন্টারনেট (ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব) নয়, সুইফট নামের সম্পূর্ণ পৃথক একটা নেটওয়ার্ক, যার ভেতরে ঢোকা বাইরের হ্যাকারদের পক্ষে অসম্ভব।
হ্যাকিং হয়েছে কি হয়নি, হয়ে থাকলে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কারও হাত ছিল কি না-এসব বিষয় তদন্তের পরেই জানা যাবে, যদি কর্তৃপক্ষ তদন্তের ফল আদৌ জনসমক্ষে প্রকাশ করে। আপাতত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে কাজটা হ্যাকাররাই করেছে, ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়াই। তদন্তের পরে যদি এটাই প্রমাণিত হয়, তাহলে একটা ভয়াবহ বাস্তবতা উদ্ঘাটিত হবে, যা কোনোভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়দায়িত্ব লাঘব করবে না। কারণ, তাহলে প্রমাণিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমের নিরাপত্তা বিশ্বের ২৫০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল।
গত বছর রুশ কম্পিউটার সিকিউরিটি কোম্পানি ক্যাসপারস্কি ল্যাব জানিয়েছিল, আগের দুই বছরে সাইবার অপরাধীদের একটা আন্তর্জাতিক চক্র বিশ্বের ১০০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করেছিল। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির এই ঘটনা যদি হ্যাকিংয়ের সাহায্যেই ঘটে থাকে, তাহলে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হ্যাকারদের কবলে পড়ার প্রথম ঘটনা হবে এটাই।
এই নজিরবিহীন ঘটনার জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের নাম চিরস্থায়ীভাবে লেখা হবে সাইবার অপরাধীদের সাফল্যের ইতিহাসে একটা মাইলফলক হিসেবে। একই সঙ্গে এই ঘটনার তাৎপর্য হবে বৈশ্বিক মাত্রার। আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের জন্য বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার উৎস হবে এই ঘটনা। এরপর আমাদের সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চুরি শুরু হতে পারে।
আমরা যদি বাস্তববাদী হই, জনগণের টাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে উপলব্ধি করি, তাহলে আতিউর রহমানের পদত্যাগের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই মহাকেলেঙ্কারির অবসান হতে দেওয়া চলবে না। এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে তার ফল জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। কী প্রক্রিয়ায়, কাদের দ্বারা টাকা চুরি হয়েছে, তার আদ্যোপান্ত বিবরণ আমরা পেতে চাই। অপরাধী যারাই হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আর ভবিষ্যতে আরও চুরি ঠেকাতে হলে আমাদের সাইবার নিরাপত্তা বাড়ানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সাইবার নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ বিবেচনা করে এই খাতের কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিমূর্ত ভালোমানুষির চেয়ে পেশাদারি মনোভাব, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহি বেশি প্রয়োজন।

মশিউল আলম: সাংবাদিক
[email protected]



মন্তব্য চালু নেই