ভারতে ২০ বছরে ৩ লাখ কৃষকের আত্মহত্যা: পেছনের কারণ কী?

ভারতে বছরের পর বছর ধরে কৃষকরা আত্মহত্যা করে আসছেন। কেউ বিষপানে, কেউবা গলায় ফাঁস দিয়ে। তবে এর পেছনের কারণ কী?

কিছুদিন আগিই দাতিরি পোপাট ঘাড়ওয়াজে নামে এক কৃষক আত্মহত্যা করে। মারা যাওয়ার আগে তিনি বলেন, “আকাশ আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে।” তিনি আসলে বিরুপ আবহাওয়ার প্রতি তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

ঘাড়ওয়াজে ৪১ হাজার ‍ইউএস ডলার (বাংলাদেশি টাকায় যা ৩২ লক্ষ টাকারও বেশি) ঋণে ছিলেন। এ ঋণের বোঝা তার জন্য বহন করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিলো। উপরন্তু পরপর দুটি ঘূর্ণিঝড় তার ফসলকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করে। এবং তার ঋণ পরিশোধের আশা ভেঙ্গে যায়।

আলজাজিরাকে ঘাড়ওয়াজের ১৬ বছর বয়সী ছেলে ভগবান দাতারি বলেন, “বাবা সত্যিই অনেক চাপের মধ্যেই ছিলো। ফসলই তার একমাত্র আশা ছিলো। কিন্তু শিলাবৃষ্টি আমাদের সবকিছু কেড়ে নিলো।” আর এই চাপের কাছেই হার মানলেন ঘাড়ওয়াজে। বিষপানে চলে গেলেন পৃথিবী থেকে।

কৃষকদের আত্মহত্যা ভারতে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘাড়ওয়াজের মৃত্যু শোক এখনো অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গত ২০ বছরে প্রায় ৩ লাখ কৃষক ঋণের বোঝা সইতে না পেরে আত্মহ্ত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। কেউ বিষপানে, কেউবা গলায় ফাঁস দিয়ে। কিন্তু তাদের সকলের আত্মহত্যার কারণ প্রায় একই ছিলো।

২০১১ সালের একটি জরিপে দেখা যায় ভারতে প্রতিদিন ৪১ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। ভারত এমন একটি দেশ যেখানে কর্মসংস্থানের মূল উৎসই হচ্ছে কৃষি। সেখানে ২০১২-২০১৩ সালে জিডিপি ছিলো মাত্র ১৩.৭ শতাংশ।

কৃষিতে বিনিয়োগ করা ভারতে অনেকটা জুয়ার মতো। কৃষকরা তাদের জমি বন্ধক রেখে বীজ ও সার কেনে, চাষাবাদ করে। আঞ্চলিক ঋণদাতা সংস্থা অনেকসময় ব্যাংকের কাজ করে এবং বছর বছর ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। একটা সময় কৃষকদেরকে সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করতে হয় ফসলের উপর। ভালো উৎপাদন হলে হয়তো ঋণ শোধ করা যাবে নয়তো জমিসহ হারাতে হবে সব। ক্ষরা, বিরুপ আবহাওয়া, বৃষ্টি অনেক সময়ই ভালো ফসল উৎপাদন হতে দেয় না এবং কৃষকেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

ঘাড়ওয়াজের স্ত্রী-তিন সন্তানের জননী এখন একজন বিধবা এবং ঋণের সম্পূর্ণ বোঝা এখন তার ঘাড়ে। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, “এ অবস্থায় আমার মেয়েকে কে বিয়ে করবে? ব্যাংক আমাদের বাড়ি ও জমিকে নিলামে তুলবে। আমাদের গরু-বাছুরকে নিয়ে যাবে। ”

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষিত আত্মহত্যা করা কৃষকদের পরিবারকে ১৫৭০ ইউএস ডলার সহায়তা দিয়ে তো কোনোভাবেই ঋণ শোধ করা যাবে না। কিন্তু যদি তিনি চান (নরেন্দ্র মোদী) তাহলে ঋণ শোধ হওয়া সম্ভব।
গ্রামটির আরেকটি পরিবারের আকুতিও প্রায় একই।

২৭ বছর বয়সী জৈবন্ত থ্যাকারি তার বাবা দ্বিলীপ ইকারামকে ১৫ মিটার গভীর কুয়োতে কাতরাতে দেখেছিলো। সেটিই ছিলো তার বাবার সঙ্গে তার শেষ দেখা। তিনি বলেন, “আমার বাবার শরীরকে তুলে আনার জন্য তিনজন শ্রমিককে নিয়োগ দিতে হয়েছিলো।”

৫৫ বছর বয়সী দ্বিলীপ ইকারাম তার জমিতে ২৩ হাজার ৬৪০ ইউএস ডলার বিনিয়োগ করেছিলো বাংলাদেশি টাকায় যা ১৮ লক্ষ টাকারও বেশি। কিন্তু শিলাবৃষ্টি তার সব ফসলকে নষ্ট করে দেয়। তার পরিবার জানায় দ্বিলীপ তার করা ৬ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলো। এ বিষয়টি তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।

রুরাল ইন্ডিয়ার মতে ১২০ কোটি জনগোষ্ঠীর ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের বেশিরভাগই কৃষক। বৃষ্টিতে অন্তত ১৯.৯৮ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা চরম বিপদে পড়ে গেছেন। ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স জানায়, ২০ শতাংশেরও কম কৃষক আত্মনির্ভরশীল। বাকি কৃষকরা আবহাওয়ার উপরে পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল। ৩ কোটিরও বেশি কৃষককে বীমা পরিকল্পনার আওতাভূক্ত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক টাকা ভর্তুকি দেয়ার পরও কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো যাচ্ছে না।

দ্বিধান্বিত ইনস্যুরেন্স পলিসিই এর মূল কারণই বলে জানালেন ফুড এন্ড ট্রেড পলিসি বিশেষজ্ঞ দেবেন্দ্র শর্মা।
কিশোর তিওয়ারী অনেকদিন ধরেই এমন আত্মহত্যা পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তিনি বলেন, এ সংকটটি ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের এজেন্ডাতে রাখেনি। তিনি বলেন, বিজেপি’র অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল আসলে গ্রামীণ ভারতের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলার দাম কমে গেছে এবং এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে ভারতের কৃষকদের উপর। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০০ জন তুলা কৃষক আত্মহত্যা করেছে।

উত্তর রাজস্থানের এক কৃষক আত্মহত্যার করার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “ পরিশ্রমী কৃষকরা কখনোই যেন তাদেরকে একা না মনে করেন। আমরা সবসময়ই আপনাদের সঙ্গে আছি। তবে বিরোধী পক্ষের দাবি, জমির উপর প্রস্তাবিত নতুন বিলটি আসলে কৃষকদের দুর্দশাই বাড়াবে। এটি তাদের কর্পোরেটদের কাছে তাদের জমি দিয়ে দিতে বাধ্য করবে।

যদিও মোদি ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবারের ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবুও কৃষকরা প্রস্তাবিত জমির বিলে তাদের সমর্থন প্রকাশ করেনি। ইন্ডিয়ান এনজিও সেন্টার এর এক জরিপে দেখা যায় প্রতিদিন ভারত প্রায় ২০৩৫ কৃষক হারাচ্ছেন। এর উদাহরণ হতে পারে ঘাড়ওয়াজের ছেলে সামাধান দাতারি। তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর আগে তিনিও আঙুর চাষে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন আর সে আগ্রহ নেই।

ঋণে ডুবে থাকা এসকল পরিবারগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয় সামাজিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কোনো ছেলেই ঋণগ্রস্থ পরিবারে বিয়ে করতে চায় না।



মন্তব্য চালু নেই