বড় হচ্ছে বাংলাদেশ, নতুন মানচিত্র আসছে

নতুন বছরেই নতুন মানচিত্র হবে বাংলাদেশের। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের বুক চিরে জেগে উঠছে নতুন নতুন ভূখণ্ড। এসব নতুন ভূখণ্ডের কোনোটিতে শুরু হয়েছে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন। কোনোটিতে আবার চলছে বনায়নের কাজ। আবার বাংলাদেশের সীমায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ায় কোনোটিতে ভূমিহীনরা শুরু করেছে বসতিও। ১৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সন্দ্বীপের তিন পাশে গড়ে ওঠা নতুন ভূমির পরিমাণ মূল সন্দ্বীপের প্রায় দ্বিগুণ! আবার নোয়াখালী জেলা ঘিরে গড়ে উঠেছে নিঝুম দ্বীপ, চরকবিরা, চরআলীম, সাগরিয়া, উচখালী, নিউ ডালচর, কেরিং চরসহ প্রায় পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটারের নতুন ভূমি। এ জেলার দক্ষিণ প্রান্তে জেগে ওঠা নতুন ভূমির মধ্যে প্রায় সাত হাজার

হেক্টরে বনায়নও করেছে বন বিভাগ। একইভাবে নতুন ভূমি জেগে উঠেছে খুলনার সুন্দরবন এলাকা ঘিরেও।

নতুন এ ভূমি খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। কারণ নতুন ভূখণ্ডে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো ও বেকারত্ব হ্রাসের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, ভূমি, বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের ছয়টি বিভাগের সমন্বয়ে কাজ করছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। নেদারল্যান্ডস ও ইফাডের আর্থিক সহায়তায় ১৯৭০ সাল থেকেই এমন সমন্বিত কাজ করছে বাংলাদেশ। সমন্বিত এমন কার্যক্রমের সুফলও মিলছে। প্রতি বছর গড়ে অন্তত ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন চরের দেখা মিলছে। তবে নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক ভাঙনের কারণে গড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এর আট বর্গকিলোমিটার। সংশ্লিষ্ট সব সূত্রে আলাপ করে জানা গেছে, ভাঙাগড়ার এ খেলার মাধ্যমেই গত চার দশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ১০ লাখ হেক্টর নতুন ভূমি। ক্রসড্যাম ও বনায়নের চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে এর সঙ্গে আরও ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ২০ লাখ হেক্টর ভূমি যুক্ত হওয়ারও সম্ভাবনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে জেগে ওঠা নতুন ভূমি মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে কাজও শুরু করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। জেগে ওঠা নতুন ভূমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে ২০১৬ সালেই কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে এ মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, ‘২০১৬ সালেই নতুন আইন চূড়ান্ত করব আমরা। এ আইনের খসড়ায় ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি উন্নয়ন, ভূমি ব্যবহার ও কৃষিজমি সুরক্ষাসহ ভূমি-সংক্রান্ত বিষয়াদি থাকবে। এ জন্য ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে নিয়ে বৈঠকও করেছি আমরা।’ একই প্রসঙ্গে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বললেন, ‘ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাইকোর্টেরও নির্দেশনা আছে। এ জন্য ভূমি ব্যবহার বাস্তবায়ন নামক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ভূমি শ্রেণীকরণের কাজ করছে। ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে এই শ্রেণীকরণের কাজ শেষ হবে।’

জানা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রতটে জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ড ব্যবহার উপযোগী করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস (সিআইজিএস), চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট (সিডিএসপি), অ্যাকুয়াচারি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইডিপি), ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংসহ (আইডবি্লউএস) এক ডজন সংস্থা। জেগে ওঠা নতুন ভূমির ফিসিবিলিটি স্টাডি করে এটি ব্যবহারের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে সরকারকে অবহিতও করছে তারা।

যেভাবে টেকসই হয় নতুন ভূমি :নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসেন জানান, সাগরের বুকে জেগে ওঠা নতুন ভূমিকে টেকসই করতে প্রথমে বনায়নের কাজ শুরু করে বন বিভাগ। ১৫ থেকে ২০ বছর বনায়ন করা হয়। নরম মাটিকে শক্ত করতে প্রথমে রোপণ করা হয় কেওড়া গাছ। এরপর পর্যায়ক্রমে রোপণ করা হয় বাইন, করমচা, পুনাইল ও কাঁকড়া গাছের চারা। এসব গাছ চরের নরম মাটিকে শক্ত করে। ১০ থেকে ১৫ বছর পর এসব গাছ বড় হয়ে মাটি আঁকড়ে রাখে। তখন নতুন ওই ভূখণ্ড মানুষের বসবাসযোগ্য হয়।

যেসব নতুন ভূমিতে বড় হবে মানচিত্র :সন্দ্বীপের উত্তরে বামনী নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী। এরও পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ। পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল। এ চ্যানেলের পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের বর্তমান দূরত্ব ১০ মাইল। নোয়াখালী থেকে ১২ মাইল এবং হাতিয়া থেকে ২০ মাইল। কিন্তু বর্তমানে এ দূরত্ব ক্রমশই কমছে। কারণ সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের আজিমপুর এলাকা থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণের দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় জেগেছে নতুন ভূমি। আবার উত্তর-পশ্চিম অংশে থাকা উড়িরচরের দক্ষিণে জেগে উঠেছে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ লক্ষ্মীচর ও ভবের চর। নতুন ভূমি জেগেছে সন্দ্বীপের পূর্ব প্রান্তেও। এ দ্বীপের উত্তরেও জেগে উঠেছে কয়েক হাজার হেক্টর নতুন ভূমি। এরই মধ্যে এ ভূমির একটি অংশকে দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ ইউনিয়নে বসবাস শুরু করা কয়েক হাজার ভূমিহীন পরিবারকে সুরক্ষা দিতে ২০১১ সালের জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। ২০১২ সালে নতুন এ ইউনিয়নে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিও নির্বাচন করা হয়েছে। সন্দ্বীপের আশপাশে জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ডে এখন চলছে কৃষিকাজ। নতুন চরের বিস্তীর্ণ ঘাস ব্যবহার করে হাজার হাজার গরু, ছাগল ও মহিষ লালন-পালন করছে নিম্নবিত্তের মানুষ। সন্দ্বীপের উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাহজাহান বিএ বলেন, ‘জেগে ওঠা নতুন ভূমির পরিমাণ সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ডের প্রায় দ্বিগুণ। যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে এ ভূখণ্ড খুলে দেবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।’ নতুন ভূমিতে গড়ে ওঠা দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘যে হারে চর জাগছে তাতে সন্দ্বীপের উত্তর সীমান্তের ভবানী নদী ভরাট হয়ে হয়তো লেগে যাবে উড়িরচরের সঙ্গে। তখন সন্দ্বীপের আয়তন আরও বাড়বে।’

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপ সংলগ্ন নতুন ভূমি নিঝুম দ্বীপেও শুরু হয়েছে মানুষের বসবাস। এ অঞ্চলের ঘন বনাঞ্চলে চরছে হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। নিঝুম দ্বীপের পাশে এখন নতুন করে জেগেছে চরকবিরা নামক একটি এলাকা। একটু দূরে গেলে দেখা মিলছে চরকালাম, চরআলীম, সাগরিয়া, উচখালী, নিউ ডালচর নামক নতুন নতুন ভূখণ্ডের। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণ এবং উত্তর প্রান্তেও জেগে উঠেছে নতুন ভূমি। একই অবস্থা দেখা গেছে কেরিং চরের দক্ষিণ প্রান্তেও।

মানচিত্রে যোগ হলো ১০ লাখ হেক্টর নতুন ভূমি : উপকূলীয় এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, গত চার দশকে বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১০ লাখ হেক্টর নতুন ভূমি পেয়েছে বাংলাদেশ। জেগে ওঠা এসব ভূমির মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ভোলা জেলায়। ক্রসড্যামের মাধ্যমে নতুন ভূমি উদ্ধার প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত একটি প্রকল্প প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ১৯৫৭ সালে এ অঞ্চলে প্রথম ক্রসড্যাম দিয়ে ২১ হাজার হেক্টর নতুন ভূমি উদ্ধার করে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে নোয়াখালীতে রামগতি নামক এলাকাকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। আবার ১৯৬৫ সালে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরও একটি ক্রসড্যাম তৈরি করে সোনাপুর রেলস্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় চরজব্বার নামক এলাকাকে। এতে উদ্ধার করা হয় প্রায় ৭৯ হাজার হেক্টর নতুন ভূমি। সিডিএসপি প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানান, মেঘনা নদী, হাতিয়া ও সন্দ্বীপ চ্যানেলে পরিচালিত পৃথক তিনটি প্রজেক্টে তারা ২৫ হাজার ৮৯৯ একর ভূমিতে এরই মধ্যে ১৮ হাজার ৫১৬ পরিবারকে পুনর্বাসন করেছেন। এদিকে ভোলার মনপুরা দ্বীপেও নতুন ভূখণ্ড পেয়েছে বাংলাদেশ। সুন্দরবন ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আশপাশে যুক্ত হওয়া নতুন ভূখণ্ডকে বিবেচনায় আনলে সব মিলিয়ে সীমানায় যুক্ত হওয়া নতুন ভূখণ্ডের পরিমাণ হবে অন্তত ১০ লাখ হেক্টর।

জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ডের সম্ভাবনা :জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ডের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে সন্দ্বীপের সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, ‘নতুন ভূমিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এ ভূমি কৃষিজ কাজে ব্যবহার করেও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারে সরকার।’ একই প্রসঙ্গে হাতিয়ার সাংসদ আয়েশা ফেরদাউস বলেন, ‘নতুন ভূখণ্ড সংরক্ষণ করা গেলে বদলে যাবে বাংলাদেশের মানচিত্র। বদলানো সম্ভব দেশের অর্থনীতিও। এ জন্য নতুন ভূমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা যে, এ জন্য কাজও শুরু করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।’

-সমকাল



মন্তব্য চালু নেই