ব্যতিক্রম এক নবাব
এক যে ছিল নবাব। যিনি অন্য নবাবদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। যিনি ভাগ্য বিড়ম্বিত অসহায় বাঙালি মুসলমানের মুক্তি, স্বতন্ত্র জাতিসত্তা নিয়ে ভেবেছিলেন এবং সেই ১৯০৬ সালেই স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাব। বলা হয়, প্রথম পানীয় জলের ব্যবস্থা, ইলেকট্রিসিটি এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।
১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এ দেশে অসংখ্য করদ রাজ্য সৃষ্টি করেছিল। তাদের তৈরি করা রাজা, মহারাজা ও জমিদাররা অত্যাচার এবং জুলুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজ নিজ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে ডায়নামিক এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল ঢাকার নবাব পরিবার।
আলোচিত এই নবাব হচ্ছেন স্যার সলিমুল্লাহ। নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর ছিলেন ঢাকার চতুর্থ নবাব। যার জন্ম ঢাকার ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলে ১৮৭১ সালের ৭ জুন। তিনি নবাব খাজা আহসানউল্লাহর পুত্র। সলিমুল্লাহ বিদেশি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গৃহে শিক্ষা লাভ করেন। কর্মজীবনে কিছুকাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে দায়িত্ব পালন (১৮৯৩-১৮৯৫) করার পর ১৯০১ সালে পিতার মৃত্যু হলে নিযুক্ত হন পরিবারের প্রধান (নবাব)।
নবাব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তিনিই রাজনীতিতে প্রথম সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তদানীন্তন ভারতের নবগঠিত ব্যবস্থাপক সভায় কোনো মুসলমান নির্বাচিত না হতে পারায় আগা খাঁ, নবাব মুহসীনুল মুলক, নবাব ভিকারুল মুলক, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ মুসলিম নেতার সঙ্গে মিলে তিনি ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর বড়লাট (ভাইসরয়) লর্ড মিন্টোর (১৯০৫-১৯১০) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা ব্যবস্থাপক সভা ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় মুসলমানদের আলাদা নির্বাচনের দাবি জানান।
সলিমুল্লাহ মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ঢাকায় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য সেই সম্মেলনে তার উদ্যোগে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৬ সালের ২৮-৩০ ডিসেম্বর শাহবাগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে গোটা ভারতের প্রায় চার হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে মুসলিম বাংলার নবজাগরণের পুরোধা, বঙ্গভঙ্গের মহানায়ক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়।
এ দেশের অনুন্নত মুসলমান সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তার অবদান অবিস্মরণীয়। মুসলমানদের অবস্থার উন্নতিকল্পেই তিনি ব্রিটিশ শাসকের কাছে বঙ্গবিভাগের দাবি পেশ করেন। বলা যায়, তার একক প্রচেষ্টায়ই তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিন্দুসমাজ ও কংগ্রেসের আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রহিত (১৯১১) করতে বাধ্য হয়। এতে নবাব সলিমুল্লাহ অত্যন্ত ব্যথিত হন। তার আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের জন্য সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ সাব-ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তিনিই প্রধান উদ্যোক্তা। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তিনি ঢাকার রমনা এলাকায় নিজ জমি দান করেন। আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, যা বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), তারও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকায় একটি এতিমখানা (সলিমুল্লাহ এতিমখানা, আজিমপুর) একটি মেডিক্যাল কলেজ (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা), একটি কলেজ (সলিমুল্লাহ কলেজ, টিপু সুলতান রোড, ঢাকা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ও একটি রাস্তার (সলিমুল্লাহ রোড, নারায়ণগঞ্জ) নামকরণ হয়েছে।
তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ রাজধানীর বেগম বাজারের মরহুমের সমাধিতে ফাতিহা পাঠ ও জিয়ারতের আয়োজন করেছে মুসলিম লীগ। এ ছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মরহুমের বেগম বাজারের মাজার জিয়ারত এবং বাদ জুমা এতিমখানা কমপ্লেক্সের গোর-ই-শহীদ মসজিদে মিলাদ মাহফিল ও এতিমখানার নিবাসীদের মধ্যে খাবার বিতরণ।
মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় বলে জনশ্রুতি আছে। মৃত্যুর পর নদীপথে নবাবের লাশ সদরঘাটে আনা হলেও কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি।
মন্তব্য চালু নেই