বিএনপির সৌজন্য বনাম সরকারের সৌভাগ্য

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নিজের কিছু দুর্বলতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য। গত সপ্তাহে লিখেছিলাম একটি প্রধান ব্যালট বাক্সের আত্মকথা নামক রচনা। সেখানে সবাইকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলাম যে, এবারের সিটি নির্বাচনে জাল ভোট, ভোট ডাকাতি ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই হবে না। কিন্তু ভোটের আগের রাতের ঘটনা এবং ভোটের দিনের তাণ্ডব দেখে আমার বারবার পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতের কথাই মনে হচ্ছে, যেখানে আল্লাহ বলেছেন- ওয়ামা উতিতুম মিনাল ইলমি ইল্লা কলিলা। অর্থাৎ তোমাদেরকে খুব সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে। আমার জ্ঞানের দুর্বলতা এবং সেই দুর্বল জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে পাঠকদের বিভ্রান্ত করার জন্য আমি অনুতপ্ত এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থী।

২৮ এপ্রিল একটি নির্বাচন হয়ে গেল। সরকার এটিকে মনে করছে তাদের একটি পরম সৌভাগ্য হিসেবে। অন্য দিকে বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জন করে নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করছে। আমিও অন্য প্রার্থীদের সাথে তাল মিলিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছিলাম। তার পরও এক হাজার ৮৮৭ ভোট পেয়েছি। কিভাবে পেলাম, কেন পেলাম- সেসব আলোচনায় না গিয়ে আমি বরং মূল প্রসঙ্গে চলে যাই। তবে এই প্রসঙ্গে আমার সম্মানিত এক হাজার ৮৮৭ জন ভোটারকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। কারণ, সংখ্যায় অল্প হলেও তারা আমাকে চিনতে পেরেছেন। ন্যায়ের পথে থেকে বহু মহামানব ৫০ বছর অকান্ত পরিশ্রম করেও ৫০ জন লোকের সমর্থন পাননি। সেই দিক থেকে আমিও বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলে কেউ হয়তো ধর্তব্যের মধ্যে নেবেন না।

আমার ভোটকেন্দ্র ছিল গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল। আমার বাসা থেকে ২-৩ মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ। আমার দুই ছেলে ওই স্কুলের ছাত্র। একজন পাস করে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি করল আর অন্যজন এখনো পড়ছে। আমি নিজেও ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। ফলে গলিটির সাথে আমার হৃদয়ের বন্ধন অতীব মজবুত। আমরা ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং একধরনের তৃপ্তি, মমত্ববোধ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলাফেলা করি। আমার স্ত্রী ভোট দেয়ার জন্য বের হয়ে গেলেন সকাল ৮টায় এবং ফিরলেন হাসিমুখে। আমি গেলাম ৯টার দিকে। গিয়ে দেখি লোকজন তেমন নেই- বড়জোর ১০-১২ জন। আমাকে দেখামাত্রই ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এগিয়ে এলো এবং জামাই আদরে বুথের কাছে নিয়ে গেল। বুথে গিয়ে দেখলাম আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারো এজেন্ট নেই। পুলিশ, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং কর্মকর্তা ও এজেন্টরা আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি সন্তুষ্টচিত্তে ভোট দিয়ে বাইরে এলাম।
বাইরে বের হওয়ার পর বৈশাখী টিভির রিপোর্টার আমার সাক্ষাৎকার নিলো। আমি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের মতো বলালাম- ভালো, সব কিছু ভালো। আমার কথা শুনে রিপোর্টার মুখ কালো করে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগল, যা দেখে আমি বেশ বিব্রত হলাম। পরে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি অমন করে মাথা নাড়াচ্ছো কেন? রিপোর্টার বলল- ভাইয়া, আপনি কিছুই জানেন না। ভোট তো রাতেই সাবাড় হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের কোথাও ভোট হচ্ছে না। যে কয়টা ব্যালট পেপার এখনো বাকি আছে, তা সকাল ১০টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে এলাম। আমাকে রাস্তায় দাঁড়ানো দেখে সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা ইসমত কাদির গামা এবং আরো একজন সিনিয়র নেতা বললেন- এমপি সাহেব, আসেন, বসেন! চা খেয়ে যান। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে চড়ে সোজা আমার অফিসে চলে এলাম। কম্পিউটার খুলে ফেসবুকে ঢুকে দেখি সর্বনাশ হয়ে গেছে। একটার পর একটা ফোন আসতে লাগল। বিএনপির এক সিনিয়র নেতা ফোন করলেন এবং জানালেন যে, তারা ভোট বর্জন করবেন। তিনি আমাকে জনাব মওদুদ আহমদের সাথে কথা বলিয়ে দিতে চাইলেন। আমি জানি, আমার ফোনটি ট্র্যাক হয়। তাই বিনয়ের সাথে বললাম, মওদুদ ভাইয়ের সাথে কথা বলা লাগবে না। আপনারা বর্জনের ঘোষণা দিলেই আমি দেবো। আমি ফোন রেখে দিলাম এবং ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় তখন ১১টা ৩০ মিনিট।

আমার অনেক বদ অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো যখন-তখন ঘুম পেয়ে বসা। মন খারাপ হলে কিংবা মস্তবড় কোনো ঝামেলা দেখা দিলে আমার ঘুমের নেশা মারাত্মক হয়ে ওঠে। সে দিনও ঘটনার ব্যতিক্রম হলো না। আমি বড় বড় কয়েকটা হাই তুললাম এবং দুপুর ১২টার সময় অফিসে বসেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লাম। উঠে দেখলাম ৩টা বেজে গেছে। অনেক মিসকল ছিল- আর কম্পিউটার খুলে দেখলাম ভোটের বাজারে রীতিমতো ডাকাতি হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মিসকলের উত্তর দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরদিন ভোটের হার দেখে খুবই অবাক হলাম। বুঝতে বাকি রইল না যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদেরকে যারা ভোট দিয়েছেন বা সিল পিটিয়েছেন, তারা কোনো হিসাবপত্র না করেই ওসব করেছেন। সবাই জানে, ঢাকায় আওয়ামী লীগের মোট ভোট মাত্র ৩০ শতাংশ। শতভাগ কাস্টিং হলেও ভোট পড়বে সোয়া পাঁচ লাখের মতো। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে- কাস্টিং ভোট ৪৭ শতাংশ। সুতরাং সরকারদলীয় প্রার্থীর ভোট হওয়া উচিত ছিল আড়াই লাখেরও কম। সেখানে কাস্টিং দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ ৩৫। আবার এই হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপি প্রার্থীকে যত ভোট দেয়া হয়েছে তা-ও বিএনপির সম্ভাব্য রিজার্ভ ভোটের তুলনায় এক লাখ বেশি। অন্য দিকে, আমাদের মতো প্রার্থীদের পক্ষে যেমন কেউ সিল পেটায়নি, তেমনি দু-চারজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারও পাননি। সেই অবস্থায় এক হাজার ৮৮৭ ভোট কম কিসে? মানুষের দুষ্টবুদ্ধির কাছে এবার বোধ হয় ইবলিসও পরাজিত হয়েছে। নাউজুবিল্লাহ।

আপাতদৃষ্টিতে ভোট শেষ হলেও নতুন করে শুরু হয়েছে রাজনীতির নয়া মেরুকরণ। বিএনপি তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকবে। আমার জানা মতে, বিএনপি এবং এর শরিক দলগুলো সরকারের পাতানো খেলায় পা দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু দলটির মধ্যকার একটি শক্তিশালী গ্রুপ প্রথম থেকেই বলে আসছিল যে, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এই গ্রুপটি সব সময় বিএনপিকে আন্দোলন-সংগ্রামের পরিবর্তে সরকারের সাথে সমঝোতা করে উদারনৈতিক রাজনীতি শুরু করার জন্য তাগিদ দিচ্ছিল। এই লবির একটি অংশ গোপনে সরকারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে গ্রিনরুম পলিটিক্স শুরু করে এবং সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তিনটি সিটেই যে জয় লাভ নিশ্চিত, সে ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিতে থাকে। ফলে হঠাৎ করে আন্দোলন থেকে সরে এসে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনের প্রহসন ও জালিয়াতির কারণে বিএনপির এই গ্রুপটি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ফলে আগামী দিনের রাজনীতিতে বিএনপি অনেকটাই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রমুক্ত থাকতে পারবে।

ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি প্রার্থী মির্জা আব্বাসের সাথে দলের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচজন নেতার বহু দিনের দূরত্ব ছিল। তারেক রহমান, সাদেক হোসেন খোকা, আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম ও হাবিব-উন-নবী সোহেল এই নির্বাচনে যেভাবে সমর্থন দিয়েছেন, তাতে বিএনপির মহানগরীর রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলেই সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
এবার আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। ঢাকাবাসী মেয়র বলতে এখন পর্যন্ত প্রয়াত হানিফ সাহেবকেই বুঝে থাকেন। তার পুত্র সাঈদ খোকন বহু গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর রাজনীতিতে গত ৮-১০ বছর ছিলেন অবহেলিত, নির্যাতিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে লাঞ্ছিত। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল, ত্রাণমন্ত্রী মায়া চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম মুরাদ, অ্যাডভোকেট আওলাদ ও হাজী সেলিমের সাথে জনাব খোকন এবং তার সমর্থকদের দা-কুমড়া, অহি-নকুল এবং সাপে-নেউলের সম্পর্ক সবাই জানে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই কয়টি লোক যে জনাব খোকনের সর্বনাশ ঘটাতেন তা প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানতেন। ফলে তিনি দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করেছেন বটে, কিন্তু বিজয়-পরবর্তী পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ঢাকায় দলীয় ক্যাডার ও পান্ডাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো নগরভবন। তারপর শিক্ষাভবন। সব সরকারের আমলেই এ দু’টি ভবন নিয়ন্ত্রণ করেন একটি একক সিন্ডিকেট। বর্তমানেও তাই হচ্ছে। কিন্তু সাঈদ খোকনের মেয়র পদে আসীন হওয়ার ১০-১২ দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। বর্তমানের গ্রুপটি বিতাড়িত হবে এবং নতুন গ্রুপ প্রতিস্থাপিত হবে। তার পিতা হানিফ সাহেবের আমলেও সেভেন স্টার গ্রুপ বনাম ফাইভ স্টার গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এখনো নগরভবনের লোকজন ভুলে যায়নি। নতুন মেরুকরণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন হাজী সেলিম। তার লোকজন তাকে ত্যাগ করে চলে যাবেন খোকনের দলে, যা কিনা পুরান ঢাকার অলিগলিকে উত্তপ্ত করে তুলবে। অন্য দিকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বাংলাবাজার, কলতাবাজার, বংশাল, নর্থসাউথ রোড ইত্যাদি এলাকায় প্রভাব বিস্তারকারী মায়া চৌধুরীও পড়বেন নতুন চ্যালেঞ্জে।

এ তো বললাম ঢাকা দক্ষিণ সিটির অবস্থা। উত্তরের আনিসুল হককে পড়তে হবে আরো মহা ঝামেলায়। নির্বাচনের সময় পুরো উত্তরের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকর্মীই মনেপ্রাণে তাকে সমর্থন জানাননি। কেবল প্রধানমন্ত্রীর ভয়ে অনেকে টেলিভিশনে ফটোশপ করেছেন মাত্র। এখন কাজ করতে গিয়ে আনিসুল হক বুঝবেন- কত ধানে কত চাল। সেই দিক থেকে চট্টগ্রামের আ জ ম নাছির সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

সমাজজীবনে সময় একটা বিরাট ফ্যাক্টর। আজ যিনি হাসছেন তিনি কাল যে গগনবিদারী হাহাকার বা আর্তনাদ করবেন না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হলো- কোনো অন্যায় ও অনিয়ম কাল-কালান্তরে হজম করে ফেলা যায় না। অন্যায়-অবিচার, জুলুম কালের পরিক্রমায় বহু গুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসে অন্যায়কারী জালেমের ওপর। ২৮ তারিখে যা হলো তার পরিণতির জন্য আমাদের বোধ হয় খুব বেশি দেরি করতে হবে না- খুব তাড়াতাড়িই আমরা হয়তো প্রকৃতির প্রতিদান পেয়ে যাবো। আর তখনই বলা যাবে কে বেশি সৌভাগ্যবানÑ আওয়ামী লীগ! নাকি বিএনপি? নাকি জামানত হারানো একঝাঁক উজ্জ্বল তারুণ্য!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য



মন্তব্য চালু নেই