বিএনপি’র কাউন্সিল: একদিনের তামাশা
গত ১৯ মার্চ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি বছর জাতীয় কাউন্সিল হতো। কাউন্সিল অধিবেশন হতো তিনদিন। জাতীয় পত্রিকাগুলো বলতো কংগ্রেসের তিনদিনের তামাশা। বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের তামাশা হলো এক দিন। মা ও ছেলের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, বাকিদের নির্বাচন চেয়ারপারসনের মর্জির ওপর। এ কাউন্সিলে কাজের কাজ হয়েছে একটা। নিঃপ্রাণ বিএনপির দেহে কিছুটা প্রাণ স্পন্দন জেগেছে। সারাদেশ থেকে হাজার হাজার কর্মী রাজধানীতে এসেছে বিনা বাধায়। এসে সম্মেলনে যোগদান করেছে। দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আর বিরিয়ানি খেয়েছেন একসঙ্গে।
দৃশ্যত, আর একটা কাজ হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের একটা লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন। মসজিদে উলুধ্বনি হবে বা ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে-এর মতো উদ্ভট কোনও কথা এই বক্তৃতায় ছিল না। রণহুঙ্কারও ছিল না। একটা গ্রহণযোগ্য বক্তৃতা প্রদানের চেষ্টা করেছেন বেগম খাদেলা জিয়া।
রুশো ফরাসি বিপ্লবের আগে সোস্যাল কন্ট্রাকটের কথা বলেছিলেন আর বেগম জিয়া ২৪০ বছর পর এ বার সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতায় সামাজিক চুক্তির কথা উল্লেখ করলেন। পুরানো বস্তা পঁচা ধারণা যে যুগের দাবি মেটাতে অক্ষম- সে উপলব্ধি যে বিএনপির মাথায় এসেছে সে জন্য সত্যই আনন্দবোধ করেছি। পথিক পথ হারিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় পথের সন্ধানের গভীর ব্যাকুলতা দেখেছি।
সম্মেলনে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি পরিকল্পনার খসড়া তুলে ধরেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই পরিকল্পনায় তিনি ক্ষমতায় গেলে, প্রধানমন্ত্রী পদে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা ও দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ করবেন বলে উল্লেখ করেছেন। আরও বলেছেন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থা পুণরায় চালু করবেন। তাদের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে। মাথাপিছু আয় হবে ৫ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হবে দুই অঙ্কে।
খালেদা জিয়া তার বক্তৃতার এক অংশে বলেছেন, ‘আমরা কি শুধু নির্বাচনের রাজনীতি করব?’ কথাটা বড়ই ব্যঞ্জনাত্মক। রাজনীতি সুন্দরতম আর্ট। তার চর্চা সুন্দর হলে তাতে কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নেই। রাজনীতিতে অকল্যাণ-অমঙ্গল এসেছে রাজনীতিবিদদের কারণে। তাদের আত্ম-উপলব্ধি এবং সচেতনতা যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসবে। রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থেকে শাসনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শাসিত পদ্ধতিতে যখন পরিবর্তন আনা হয় তখন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী আর শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী। উভয় দল মিলে সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে সেই পরিবর্তনের সময় দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন তখন অনুতাপ করে বলেছিলেন, কবর জেয়ারত ছাড়া এখন রাষ্ট্রপতির আর কোনও কাজ নেই।
বিএনপির এ সম্মেলনে বেগম খালেদা তার ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের কথা বলেছেন কারণ এতো ক্ষমতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নাকি একনায়ক হয়ে উঠেছেন। ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে গেলে দ্বন্দ্ব সংঘাতের সূত্রপাত হয়। পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। আর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্বের কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি দুই দুই বার অকারণে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছিলেন। পদ্ধতির কারণে নয়, মানুষে মানুষে তফাতের কারণে এসব গুণগত পরিবর্তন হয়ে থাকে।
১৯৫২ সালে ভারতীয় লোকসভার যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে বিরোধীদলের সদস্য ছিল খুবই অল্প। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনেও ভারতীয় লোকসভায় মোটাতাজা বিরোধী দল ছিল না। কিন্তু এর পরও ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, হিরেন মুখার্জী, সৈয়দ বদরুদ্দুজা যখন বক্তৃতা দিতে উঠতেন তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন। নেহেরু সবই মেনে নিতেন। অথচ ইন্দিরা গান্ধীর সময় দৃশ্যপট বদলে যায়। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে জনতা দল ক্ষমতায় আসে মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হন। সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী বায়বেরেরী নির্বাচনি কেন্দ্রে রাজ নারায়নের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু কিছু দিনের মাঝে ইন্দিরা গান্ধী চিগমাগালুর আর মহসীনা খিদুয়াই আজমগড়ে উপনির্বাচনে জিতে আসেন। জনতা দলের সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে লোকসভায় বসতেই দেননি। তার সদস্যপদ খারিজ করে মোরারজির সরকার তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। তৃতীয় বিশ্বে কি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কি প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার সর্বত্র একই অবস্থা।
বেগম জিয়া তার বক্তৃতায় যাকে যেই মেসেইজ দেওয়ার সবই দিয়েছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনও দাবিও উত্থাপন করেননি। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন বলেছেন। কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন আবার বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কোনও সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীর জায়গা বাংলাদেশে হবে না বলেও বলেছেন। এই সব কথা বলে ১০ ট্রাক অস্ত্রের কথা ভুলানো সম্ভব কি-না জানি না। তবে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়। তারা সহজে ১০ ট্রাক অস্ত্রের কথা বিস্মিত হবেন বলে মনে হয় না।
খালেদা জিয়া তার ভাষণে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার কথা বলেছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের আরও বহু পরিবর্তনের প্রয়োজন নতুবা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা কার্যকর হবে না। নিম্নকক্ষে একদল আর উচ্চ-কক্ষ অন্যদল সংখ্যা গরিষ্ঠ থাকলে কখনও বিল পাস হবে না। লেজে প্রাণ থাকলেও আমাদের দেশে ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা রাজনীতিবিদদের নেই। সার্বক্ষণিক একে অপরকে খতম করার মানসিকতা তাদের।
খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া দলের চেয়ারপারসন এবং ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সম্মেলনে এরপর আর কারও নির্বাচন হয়নি। বেগম জিয়াকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তিনি অবশিষ্ট সব কিছু নির্ধারণ করবেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিবের পদটা চূড়ান্ত করা উচিৎ ছিলো। এ পদটা ঝুলিয়ে রাখা বেগম জিয়ার রাজনৈতিক অদূরদর্শীতার চূড়ান্ত পরিচয় বহন করে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে বহু জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন আর কত পরীক্ষার সম্মুখীন হলে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে কে জানে!
বিএনপি নেতাদের মাঝে মির্জা আলমগীরই সৎ এবং সজ্জন ব্যক্তি। অবশিষ্ট যারা আছেন সবাইতো বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় আবদ্ধ। খাড়া দলিল করে বাড়ির মালিক হওয়া থেকে এতিমখানার তহবিল খেয়ে ফেলার মতো সব অভিযোগইতো নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। আলমগীরের মতো সৎ সজ্জন ব্যক্তিকে নিয়ে খেলা না করাই ভালো ছিল।
বেগম জিয়া গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করলেও তার দলে তিল পরিমাণ গণতন্ত্রের চর্চা দেখাতে পারলেন না এ বারের কাউন্সিলে। সুতরাং সচেতন লোক যদি তার বক্তব্যকে কাগুজে প্রতিশ্রুতি মনে করে তাতে দোষের কিছু থাকবে না।
লেখক:আনিস আলমগীর, সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]
মন্তব্য চালু নেই