এজিবি কলোনির ‘বাইক সন্ত্রাস’: ওরা মা হারা করল ১ বছর ৮ মাস বয়সী শিশু কন্যাকে

ডজনখানেক কিশোর-তরুণের এক একটি দল; মোটর বাইক তাদের বাহন। মতিঝিল এজিবি কলোনি ঘিরে এই বখাটেরা কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব। এদেরই একটি দলের বখাটেপনায় পাঁচদিন আগে প্রাণ গেছে সরকারি চাকুরে এক নারীর।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই ঘটনায় নিহত গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী রুনা আক্তারের (২৬) স্বামী লুৎফর রহমান একটি মামলা করলেও তারা নিজেরাই এখন আতঙ্কে আছেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ‘হুমকি পাচ্ছেন’ বলে জানিয়েছেন রুনার বাবা মোহাম্মদ সোবহান।

ওইদিন রুনাকে ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে তারপর মোটর সাইকেলের চাকায় পিষে পালানোর সময় স্থানীয়দের হাতে আটক হয় আল আমিন সোহান ওরফে সোহান শাহরিয়ার (১৯) নামে এক তরুণ। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও একই বাইকে তার সঙ্গে থাকা আরও দুজনকে কেন ধরা হচ্ছে না সে প্রশ্ন তুলেছে রুনার পরিবার।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র কুণ্ড পূজার ছুটিতে থাকায় বাকিদের গ্রেপ্তার বা তদন্তের বিষয়টিও আগাচ্ছে না।

তিনি বলেন, “আমি ছুটিতে। এ মুহূর্তে কিছু করতে পারছি না। ছুটি শেষে ফেরার পর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব।”

BIKERS-2

অস্ত্র তাদের মোটরবাইক

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার বখাটে কিশোর-তরুণদের কয়েকটি দল এজিবি কলোনি বাজারের কাছে মোটর সাইকেল নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দেয়। সন্ধ্যার পর শুরু হয় প্রতিযোগিতার নামে তাদের বখাটেপনা।

রাস্তায় যানবাহনের মধ্যে কে কত দ্রুত চালিয়ে আগে যেতে পারে- এটাই তাদের প্রতিযোগিতার বিষয়। বেশভূষা, চালচলনেও তারা সমবয়সী অন্যদের চেয়ে আলাদা।

ওই বাজারের একজন সবজি বিক্রেতা জানান, এই বখাটেদের দলগুলোর আলাদা আলাদা নামও রয়েছে। গত শুক্রবার গ্রেপ্তার আল আমিন সোহান `জাম্বু গ্রুপের’ সদস্য। তাদের ছয়টি মোটর সাইকেল সেদিন রাস্তায় ছিল। ‘পট্টি’ ও ‘দুল’ নামে আরও দুটি দল আছে এজিবি কলোনি বাজারে।

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “এরা প্রতিদিনই মোটর সাইকেল নিয়ে কিছু না কিছু ঘটায়। কারও ওড়না টানে, ব্যাগ নিয়ে যায়। ওরা প্রভাবশালী লোকজনের ছেলে। কেউ কথা বলার সাহস পায় না।”

ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ছত্রছায়ায় এই কিশোরেরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল থানার ওসি বিএম ফরমান আলী বলেন, “ওই এলাকায় মোটর সাইকেলের এমন গ্রুপ আছে কিনা তা আমার জানা নাই।”

RUNA-FAMILY

যেভাবে প্রাণ গেল রুনার

এক সহকর্মীর বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার জন্য শুক্রবার সন্ধ্যায় ছোট বোন তানিয়া আক্তার বীথিকে সঙ্গে নিয়ে এজিবি কলোনির বাসা থেকে বের হন রুনা। বাসায় রেখে যাওয়া ১ বছর ৮ মাস বয়সী মেয়ে রাইকার কাছে আর ফেরা হয়নি তার।

বীথি জানান, কলোনির ভেতরে রিকশা না পেয়ে পায়ে হেঁটে মূল সড়কে যান তারা। রাস্তা পার হওয়ার সময় মাঝখানের আইল্যাণ্ডে ওঠার পরপরই পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে কয়েকটি মোটরসাইকেল রাজারবাগের দিকে ছুটে যায়।

৪/৫টি মোটরসাইকেল চলে যাওয়ার পর ওপারে যাওয়ার জন্য আবার রাস্তায় পা রাখেন রুনা। এমন সময় পেছন থেকে আরেকটি মোটরসাইকেল রুনার পাশ দিয়ে ছুটে যায়।

“মোটর সাইকেলে থাকা তিনজনের একজন আমার বোনের ওড়না ধরে টান দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপা ছিটকে মোটর সাইকেলের ওপর পড়ে। এতে ওরা গতি বাড়িয়ে দেয়। আমার বোনকে ওভাবেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আইল্যান্ডের উপরে আছড়ে ফেলে, বিকট শব্দ হয়।”

এরপর রুনার পায়ের ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে নিয়ে যায় তিন বখাটে।

“দৌড়ে গিয়ে দেখি আমার বোন আইল্যান্ডের পাশে পড়ে আছে। আমার দিকে এক পলক তাকাল, তারপর চোখ বুজে গেল। আর খুলল না। আপার মাথা ধরে তুলতে গেলাম, আমার হাতে ওর মগজ লেপ্টে গেল,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন বীথি।

রুনার ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়ে তিন বখাটে পালানোর সময় তাদের মোটর সাইকেলের চাকায় ওড়না আটকে যায়। সঙ্গে থাকা দুজন দৌড়ে পালাতে পারলেও স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে আল আমিন সোহান ওরফে সোহান শাহরিয়ার।

ঘটনাস্থল থেকে রুনাকে প্রথমে নেওয়া হয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে; সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে বলে জানান রুনার ভগ্নিপতি জোবায়রুল আমিন।

SOHAN

মাকে খুঁজছে রাইকা

গণপূর্ত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মোহাম্মদ সোবহানের এক ছেলে পাঁচ মেয়ের মধ্যে রুনা চতুর্থ। বীথি ছাড়া বাকি সবার বিয়ে হয়ে গেছে।

হাবিবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর বছর চারেক আগে গণপূর্ত বিভাগের মেডিকেল শাখায় হিসাব সহকারী হিসেবে যোগ দেন রুনা। বাবার নামে বরাদ্দ এজিবি কলোনির বাসাটিই পরে তার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মৃত্যু বোঝার বয়স এখনও হয়নি রুনার মেয়ে রাইকার। খালাদের কোলে কোলে ঘুরতে ঘুরতেই মাকে খুঁজছে সে।

সোবহান বলেন, “ছোট মেয়েকে নিয়ে রুনার সংসারেই আমরা থাকতাম। মেয়ের পরিবারের টাকা আর আমার পেনশনের টাকাতেই সংসার চলছিল। কিন্তু চোখের পলকে সব শেষ হয়ে গেল।”

SOHAN--SAHRIAR

মামলা তোলার ‘হুমকি’

সোবহান বলেন, রুনার স্বামী মামলা করার পর থেকে নানাভাবে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার থানায় একটি জিডিও করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার সোহানের সঙ্গে ওই মোটর সাইকেলে আরও দুজন থাকলেও পুলিশ ‘রহস্যজনক কারণে’ তাদের গ্রেপ্তার করছে না বলে রুনার বাবার অভিযোগ।

সোহানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে তার ফেইসবুক পেইজে নাম দেখা যায় সোহান শাহরিয়ার। কিন্তু মামলায় তার নাম লেখা হয়েছে আলআমিন সোহান।

বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ কলেজের ছাত্র সোহানের বাসা আরামবাগে। ওই এলাকার এক ছাত্রলীগ নেতার ভাগ্নে সে। স্থানীয়দের ভাষ্য, ওই ছাত্রলীগ নেতা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু সাঈদের অনুসারী। তারাই সোহানকে বাঁচাতে ‘মরিয়া হয়ে উঠেছে’ বলে অভিযোগ করেন রুনার এক বোন।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কাউন্সিলর আবু সাঈদ বলেন, “যতই পরিচিত হোক। এ ঘটনা অন্য রকম। মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমি শুনেছি পরদিন। এখানে সোহানকে রক্ষা করার চেষ্টার প্রশ্নই আসে না।”

রুনার পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মতিঝিল থানার ওসি ফরমান আলী পাল্টা প্রশ্ন করেন, “মোটর সাইকেল চালককেতো গ্রেপ্তার করেছি, আর কাকে গ্রেপ্তার করব?”

বাকি দুজনের বিষয়ে কোনো ‘তথ্য নেই’ জানিয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। আর তারা প্রভাবশালী কিনা তাও জানি না।”

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র কুণ্ডু বলেন, “রুনার পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। সব ব্যবস্থাই আমরা নেব।” বিডিনিউজ২৪



মন্তব্য চালু নেই