বাংলাদেশ ভুল পথে হাঁটছে : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা দুর্নীতি

বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নাজুক উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছেন সুইডিশ ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটস, ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের ফরেন এফেয়ার্স এবং হিউম্যান রাইটস কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ল্যার অ্যাডাকটুসন।

বৃহস্পতিবার দেয়া ওই বিবৃতিতে তিনি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ এখন ভুল পথে হাঁটছে। অ্যাডাকটুসন অত্যন্ত কড়া ভাষায় বিগত নির্বাচনের সময়ে সহিংসতা, রাজনৈতিক হত্যা, কিডন্যাপ, গুম, খুনের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, সেই নির্বাচনে ১৫০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়েছিল।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শিশু সামিউল রাজন হত্যার বীভৎস দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেশটি কতো ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদিও দেশটির নিয়ন্ত্রণ করছে, তথাপি সিভিল সোসাইটি, ব্লগার, সাংবাদিক হত্যা একের পর এক বেড়েই চলছে এবং আইনের শাসন ক্ষয়িষ্ণু এবং গণতন্ত্র ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে।

অ্যাডাকটুসন বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশটি পুলিশী রাষ্ট্র অথবা গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দেশটির সরকারকে সহিংসতা বন্ধ এবং বিরোধীদের দমনের পন্থা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচিত ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে দেশটির নেতৃত্বের সাথে সকল ধরনের সহযোগীতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উইথড্র করার কথা ভাবতে হবে।

এদিকে, মার্কিন গবেষণা সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের (ডব্লিউজেপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশ বাংলাদেশ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে আছে এ দেশটি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা দুর্নীতি। সরকারের উন্মুক্ততার দিক থেকে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। বিশেষ করে মিডিয়ার ক্ষেত্রে তা তলানিতে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতাও সামান্য। আইন লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশকে শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম।

চলতি বছর ‘ডব্লিউজেপি রুল অব ল ইনডেক্স ২০১৫’ নামে বিশ্বের মোট ১০২টি দেশের ওপর সংস্থাটি সম্প্রতি ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে নিচের দিকে ৯৩ নম্বরে অবস্থানে। গত এক বছরে আইনের শাসনের সূচকগুলোর কী পরিবর্তন হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে এতে।

প্রতিবেদনে কার্যকর আইনের শাসনের সুফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, কার্যকর আইনের শাসন দুর্নীতি কমায়, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি লাঘব করে এবং জনগণকে অবিচার থেকে সুরক্ষা দেয়। নয়টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- সরকারি ক্ষমতার সংযত প্রয়োগ, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, প্রয়োগকারী সংস্থা, দেওয়ানি বিচার, ফৌজদারি বিচার ও অনানুষ্ঠানিক বিচার।

সরকারি ক্ষমতার সংযত প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বে ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তে। দুর্নীতির অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৮ নম্বর অবস্থানে। উন্মুক্ত সরকারের ক্ষেত্রে ৭৩ নম্বরে। মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ৮৮ নম্বরে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। প্রয়োগকারী সংস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৬ নম্বরে। দেওয়ানি বিচারে ৯৩তম ও ফৌজদারি বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখানে মিডিয়ার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা মাত্র ২৮ ভাগ। রাজনৈতিক দলগুলোর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা ৩১ ভাগ। সুশীল সমাজের সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা আছে শতকরা ৩১ ভাগ। জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে শতকরা ৪০ ভাগ।

বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার সমাধানের জন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দ্বারস্থ হবে কি না এ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে দুর্নীতি বেশ প্রবল। সেখানে কি প্রতিকার মিলবে সে বিষয়ে সচেতনতার অভাব আছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের বিরুদ্ধে রয়েছে পক্ষপাতিত্বের জোরালো অভিযোগ। তবে এক্ষেত্রে কোর্ট ফি খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে সে সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখানে বিচারের আগে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। মানবসম্পদের ঘাতটি রয়েছে। বিবাদির আইনি সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। রয়েছে দুর্নীতি।

ওই রিপোর্টে পুলিশের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তারাও যে আইনের সেবা করেন তার বাইরে নন। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের জিজ্ঞাসা করে তার উত্তরের ভিত্তিতে পুলিশের জবাবদিহিতা সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছিল- এক. আইন অনুসারে কি পুলিশ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে? দুই. সন্দেহজনক ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের প্রতি কি পুলিশ সম্মান দেখায়? তিন. আইন লঙ্ঘনের জন্য কি তাদেরকে শাস্তি পেতে হয়েছে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যে তথ্য মিলেছে তা হতাশাজনক। প্রথম প্রশ্নের জবাবে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ মানুষ বলেছেন তারা মনে করেন পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করে। শতকরা ২৬ ভাগ মানুষ মনে করেন সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায় পুলিশ। তবে পুলিশকে আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। শতকরা মাত্র ১৮ ভাগ মানুষ এক্ষেত্রে ইতিবাচক জবাব দিয়েছে।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আইনের শাসনে পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে নেপালের অবস্থান ৪৮তম। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৫৮), ভারত (৫৯), বাংলাদেশ (৯৩), পাকিস্তান (৯৮) ও আফগানিস্তান (১০১)। ওই সূচক অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের যে সাতটি অঞ্চলের ১০২টি দেশে ডব্লিউজেপি সমীক্ষা চালিয়েছে, তার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) এবং উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ আইনের শাসন সূচকে এগিয়ে আছে। প্রথম থেকে চতুর্থ অবস্থানে আছে চারটি দেশ- ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। এই সূচকে ব্রিটেন ১২তম, আমেরিকার অবস্থান ১৯। সবশেষ ১০২তম অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা।

সুত্র: রেতে



মন্তব্য চালু নেই