‘বাংলাদেশে মরলে জানাজা পড়ার মানুষ তো পাবো!’

মিয়ানমারের আগের (জান্তা সরকার) সরকারের সময়ও অত্যাচার ছিল। তবে এবারের মতো এত ভয়াবহতা আর কখনও দেখিনি। হঠাৎ করেই সেনাবাহিনী একেকটি গ্রাম ঘিরে ফেলে। একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পালানোর সময় মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের ধরে ধরে নির্যাতন করেই চলছে। এদের (সেনাবাহিনীর) হাতে মরতে চাই না। মৃত্যু হলে বাংলাদেশে মুসলিমদের হাতেই হোক। এখানে (বাংলাদেশে) অন্তত জানাজার পড়ার মানুষ তো পাবো!’ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ছফুরা বেগম এসব কথা বলেন।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

ছফুরা (বয়স আনুমানিক ৬০ বছর) জানান, তার বাড়ি মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু উপজেলার কেয়ারিপাড়া গ্রামে। ওই গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন তিনি। দুদিন আগে আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে। বুধবার (২৩ নভেম্বর) ওই ক্যাম্পেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ছফুরা বেগমের।

দেশ ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে বাংলাদেশে আসা ছফুরা বেগম বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে বের হই। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে লুকিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি।’

তিনি জানান, পাঁচ ছেলে এক মেয়ে আছে তার। স্বামী মারা গেছেন সাত বছর আগে। মিয়ানমারের নাগরিকতার স্বীকৃতি না পেলেও আরও অনেকের মতো ভালোই চলছিল তার সংসার। প্রায় এক সপ্তাহ আগে ওই সংসারে নেমে আসে কালো ছায়া। ওইদিন দুপুরে মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর একটি দল বাড়িতে ঢুকে তার একমাত্র মেয়েকে নির্যাতন করে। পরে বাড়িতে থাকা আসবাবপত্র তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। চলে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনী তার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা আর বাড়ি ফিরে আসেনি। কোনও উপায় না দেখে অন্যান্যদের মতো বাংলাদেশে চলে আসার সিন্ধান্ত নেন, জানিয়ে কেঁদে ফেলেন ছফুরা। তিনি জানান, ‘তিনি তার তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।’

তিনি বলেন, ‘জীবনে ৬০টি বছর পার করলেও কখনও বাংলাদেশে আসিনি। আমাদের কোনও আত্মীয়-স্বজনও এখানে আসেনি। মেয়েটার ওপর সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কথা মনে হলে শরীর এখনও শিউরে ওঠে। এ কারণে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছি এই দেশে।’

বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতেই আরেক বিপদে পড়েন বলে জানান ছফুরা। নাফ নদীতে ঘাট মাঝিকে মাথাপিছু মিয়ানমারের মুদ্রায় ১২ হাজার টাকা দিয়ে এপারে আসেন তারা। নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের তীরে ভেড়ার পর স্থানীয় দালালদের খপ্পরে পড়েন। কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশি এক হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেয় দালালরা। শরণার্থী ক্যাম্পে আসা পর্যন্ত সব হারিয়ে ছফুরা এখন নিঃস্ব। প্রাণে বেঁচে আছেন সান্তনা এতটুকুই।

গত এক সপ্তাহে ছফুরার মতো হাজারো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। ছফুরা বেগমের সঙ্গে আসা ও ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া কবির আহম্মদ (৩৫), ফজল করিম (৪২), শফিক আহম্মদ (২৮), আব্দুর রশিদ (৩২), ছেমন বাহার (২০), আনোয়ারা বেগম (১৮), গোলবাহার (৭৫) জানান, মিয়ানমার সরকার যেভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাতে আরাকান রাজ্য শিগগিরই মুসলিমশূন্য হয়ে পড়বে।

তারা আরও জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় যুবকদের হাত-পা বেঁধে মাথা নিচু করে গুলি করে হত্যা করছে। এসব কাজে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু রাখাইন যুবক। তাদের অত্যাচার সেনাবাহিনীর চেয়েও জঘন্য বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, গত ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রাখাইন প্রদেশ থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে। প্রথমে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা কম থাকলেও দিন দিন তাদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিজিবি’র কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করেই দলে দলে আসছে রোহিঙ্গারা।

উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পের ইনচার্জ আরমাণ শাকিল বলেন, ‘এখানে ১১ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। এর বাইরেও আরও হাজারো রোহিঙ্গা রয়েছে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেখার বিষয় না। সরকার এই বিষয়টি দেখবে।’

কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, ‘নাফ নদী পার হয়ে এবং অন্যান্য পথে আসা রোহিঙ্গাদের আবার সেই পথেই ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যারা তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে, সেই দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’



মন্তব্য চালু নেই