বাংলাদেশের পোশাক কারখানাই বিশ্বসেরা
আব্দুল আলিম : সমস্যা মুক্ত নয় বাংলাদেশ, সমস্যা মুক্ত নয় বিশ্বের কোন দেশ, সমস্যা মুক্ত নয় বিশ্ব, তেমনি সমস্যামুক্ত নয় বাংলাদেশের পোশাক খাত। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও তাদের জীবন মানের উন্নয়নসহ অনেক কিছুতেই অগ্রগতি হয়েছে, হচ্ছে তবে আরও উন্নয়নের প্রয়োজন, সেটাও একদিন হবে। তবে ঢালাওভাবে চোখ দুটি বন্ধ করে শুধু পোশাক কারখানাগুলির বারবার নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে বুলি না আওড়িয়ে একটু ৩০ বছর আগের এ দেশের আর্থ-সামাজিক চেহারার কথা মনে করে আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।২০ বছর আগের কারখানার ছবি আজকের পোশাক কারখানার সাথে তুলনা করলেই কারখানার মানোন্নয়ন হয়েছে কিনা তা বুঝতে কারো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের অন্য কারখানার শ্রমিকের নিরাপত্তা, চাকরির নিরাপত্তা, ন্যূনতম জীবন ধারনের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা বা বাংলাদেশের শ্রম আইনের ন্যূনতম প্রতিফলন নাই। পোশাক কারখানাগুলিকে অনেকেই মৃত্যুকুপ বলে থাকলেও অন্য কোন কারখানা যেমন ধোলাইখালের ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য গড়ে উঠা পোশাক খাত, মটর ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, গ্লাস কারখানা, স্টিল মিল, জাহাজ শিল্প, কেমিক্যাল কারখানাগুলি সমন্ধে কোন ধারনা রাখেন না এ কথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে।
এক সময়ের ঘিঞ্জি, নোংরা পোশাক কারখানাগুলি সময়ের পরিক্রমায় এখন অনেক বেশি আধুনিক, সনাতন পদ্ধতির পোশাক কারখানাগুলি এখন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। এখন শুধু আইন বা ক্রেতার জন্য নয় আধুনিক প্রজন্ম টেকসই কারখানার ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পোশাক শিল্পের সবুজ বিপ্লবের দিকে। বিশ্বসেরা ১০ পরিবেশ বান্ধব কারখানার মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশের কারখানা। ওই তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের কোন পোশাক কারখানাই স্থান পায় নি। তাহলে পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ভাল পোশাক কারখানা নেই বলা যায়?
২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা এদেশের পোশাক খাতের অগ্নি নিরাপত্তার দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে। পরবর্তীতে কারখানা মালিক, সরকার, ক্রেতা সহ সকলের যৌথ উদ্যোগে আজকের পোশাক খাতের অগ্নি ঝুঁকি অনেক কমে এসেছে এবং গত তিন বছরে পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ডে কোন নিহতের খবর পাওয়া যায়নি। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কারখানা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল ২০১৩ সালে। অভিশপ্ত রানা প্লাজা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে ফেলে দিয়েছিল চরম এক হুমকির মধ্যে। দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আরেকটি না ঘটলেও ভয়াবহতম এই ভবন ধ্বসের ঘটনায় সাড়া পৃথিবী আঁতকে উঠে। অলিখিতভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে অনিরাপদ কারখানার তকমাটা লেগে যায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের গাঁয়ে। এখনও অনেকের কাছে দুঃস্বপ্নের নাম রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন। তবে এই দুর্ঘটনার পর সরকার, মালিক ও ক্রেতারা মিলে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তার সফলতার প্রমাণ সবারই জানা।
এবার মজুরী প্রসঙ্গ, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ যা দিয়ে ঢাকা বা তাঁর আশপাশের এলাকায় সাধারণ জীবন ধারনের জন্য অপ্রতুল। কিন্তু বাস্তবতা হল, এ দেশের লাখ স্নাতক ডিগ্রীধারী বেকার। আর পোশাক কারখানার আশীর্বাদে ১৮ বছরের লেখাপড়া না জানা একজন ছেলে বা মেয়ে কাজের কোন ধারনা ছাড়াই পেতে পারে একটি চাকরি যেখানে অতিরিক্ত সময় কাজ করে আরও বেশি আয়ের সুযোগও রয়েছে। যারা এ দেশের পোশাক খাতের বেতন কম বলে মানবাধিকার বা শ্রম অধিকারের সর্বনাশ দেখেন তাদের চোখে পেটে ভাতে লেদ মেশিনের ধারালো ব্লেডের নিচে ১০ বছরের শিশু সন্তান কাজ করছে তা চোখে পড়েনা। তাদের এটাও বুঝার শক্তি নাই যে, আজকে বাংলাদেশে হাজার হাজার পোশাক কারখানা হওয়ার একমাত্র কারণে সস্তা শ্রম। গায়ে শ্রমিক নেতার সিল মেরে যারা শ্রম অধিকার নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছে তাদের অধিকাংশই শ্রমিক নয়। তারা খুব ভালো করেই জানে ১৬০০০ টাকা বেতন দিলে বাংলাদেশে কারখানা চলবে না। তবুও মালিক পক্ষের কাছ থেকে স্বল্পকালীন সুবিধা পাবার আশায় হয়তো শ্রমিক নামধারী অশ্রমিকরা অবাস্তব কিছু দাবি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। কিন্তু লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হচ্ছে এ বিষয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নাই। এই শ্রমিক নেতারা কোনদিন পোশাক খাতের বাইরে অন্য কোন শিল্পের ন্যূনতম বেতনের দাবীতে মানববন্ধন করেন না। গার্মেন্টস/টেক্সটাইল ছাড়া অন্য খাতের ন্যূনতম বেতন এই খাতের চেয়ে অনেক কম। তাদেরও তো জীবন ধারন করতে হয়। তাহলে কেন শুধুই পোশাক খাতের বেতন নিয়ে এ দেশে আন্দোলন হয়? একটু ভেবে দেখলেই অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে, পরিষ্কার হবে অনেক কিছু। অন্য দেশের ন্যূনতম বেতনের সাথে তুলনা বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী যেকোন দেশের চেয়ে এ দেশের বেতন কম এটা সত্য। তবে এর সাথে এ দেশের শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার বিষয়টি এড়িয়ে গেলে বিষয়টি একপেষে হয়ে যায়। শ্রমনির্ভর কারখানার শ্রমিকদের বেতন বা আয়ের সাথে কর্মদক্ষতার সম্পর্কটা প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি নিবিড়। ক্রেতা পোশাকের মজুরী কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের চাইতে এ দেশে বেশি দেয় না কিন্তু এ দেশের শ্রমিক দিনে যে উৎপাদন দেয় তা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু শ্রমিক নেতাদের আন্দোলন, হুমকি, ধামকি শুধু মালিকদের বিরুদ্ধে হলেও শ্রমিকদের সক্ষমতা বা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে শ্রমিক নেতাদের বা শ্রমিক সংগঠনগুলির কোন ভুমিকা কোনদিন দেখা যায় নি।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের নারী শ্রমিকরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়। ভারতের সুমাঙ্গালি প্রথা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম দাস প্রথা যেখানে যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক যথেচ্ছা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কিন্তু প্রতিবাদ করার কন সুযোগ নেই।
ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ড সহ আরো অনেক দেশে চলছে আধুনিক দাসত্ব প্রথা। যে কারনেই দুনিয়াকে সভ্যতা শিখিয়ে এখন এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে ইংল্যান্ড এ আধুনিক দাসত্ব নির্মূলে আইন করতে বাধ্য হয়েছে সে দেশের সরকার।
হরহামেশাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ইংল্যান্ড এর বিভিন্ন শিল্প শহরসহ নানা এলাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতনের অর্ধেকও পায় না বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে খবর আসে।
কেনিয়াসহ আফ্রিকার অনেক দেশে শ্রমিকরা সশস্ত্র অবস্থায় কারখানায় প্রবেশ করার খবরও কখনও শোনা যায়।
বাংলাদেশের বিকল্প ভেবে সকল মুনাফা পাগল পোশাক ক্রেতারা মায়ানমারের দিকে ঝুঁকে পড়লেও তারা যে এখনও সভ্য হয়নি তাঁর প্রমাণ দিয়েছে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা কোনভাবেই এই শতকের পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য নয়। আর বাংলাদেশের মত মানের পোশাক রপ্তানীতে সক্ষমতা অর্জনে মায়ানমারকে গুণতে হবে অনেক বছর।
ভিয়েতনামের কারখানাগুলি বাংলাদেশের আধুনিক কারখানাগুলি থেকে কোন দিক থেকেই উন্নত নয়। ভারটিকাল সম্প্রসারণ নীতির কারণে অনেকে তাদের কারখানা নিরাপদ মনে করলেও কারখানার বাইরে চরম অনিরাপদভাবে যাতায়াত করতে হয় ভিয়েতনামের পোশাক শ্রমিকদের। খোলা ট্রাকে গাদাগাদি করে কারখানায় পৌঁছাতে অনেক সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে শ্রমিকদের।
কম্বোডিয়ায় প্রায় নিয়মিত শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবীতে আন্দোলন করতে দেখা যায় এবং সাম্প্রতিক কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে সেখানকার কারখানাগুলির শ্রম অধিকার নিয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে।
পাকিস্তান তো অনেক আগেই পৃথিবীর ছোটখাটো নরকে পরিণত হয়েছে যেখানে কেউ যেতে চান না। ভয়ঙ্কর যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে যেখানে নিরাপত্তা কর্মীরা দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে অধিকারের কথা বলার সাহস পাবে কোথায় শ্রমিকরা।
তার মানে বাংলাদেশের চেয়ে কম সমস্যাসঙ্কুল পোশাক শিল্প কোন দেশে খুঁজে পাওয়া দায়। যাদের বাংলাদেশের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন দেশের কোন পোশাক কারখানা দেখার সুযোগ হয়েছে তারা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের পোশাক কারখানাকেই এগিয়ে রাখবেন।
সার্বিক বিবেচনায় পোশাকের মান, দাম, নিরাপত্তা, পেশাদারিত্ব ও শ্রমিকের অধিকার বিবেচনায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা বিশ্বের অন্য যেকোনো পোশাক শিল্প কারখানার তুলনায় উন্নত, নিরাপদ, শ্রমিকবান্ধব। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি আর দ্রুত গতিতে একটি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার পথ করে দেয়া এই দেশের পোশাক খাতকে নিয়ে কঠোর নেতিবাচক সমালোচনা করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ। শ্রমিক অধিকার রক্ষার নামে যারা বিদেশী সংগঠনের সাথে আঁতাত করে বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে নিরীহ শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছে তাদের এসব ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখার এখুনি সময়। না হলে অনেক কঠিন মুল্য দিতে হবে আমাদের পুরো জাতিকে, পিছিয়ে পড়বে আমাদের সোনার বাংলা। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন।
মন্তব্য চালু নেই