বাঁশের খুঁটির ওপর ঢালাই ছাদ !

রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের পাশে ‘সাদেক খান কলোনি’তে শতাধিক পরিবারের বসবাস। মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খান কলোনির জমির মালিকানা দাবি করলেও কাগজপত্রে তা সরকারি জলাভূমি। বছরখানেক আগে জলাশয় ভরাট করে এখানে নির্মাণ করা হয় টিনের ছয়টি ‘দোতলা ভবন’। ‘ভবনের’ নেই ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিমূল। জলাশয়ের নরম মাটিতে পোতা বাঁশের খুঁটি ও কাঠের পাটাতন। তার ওপর সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া মেঝে! শুধু এক তলায় নয়, দ্বিতীয় তলার পাকা মেঝেও বাঁশের খুঁটির ওপর। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সব কিছুর সংযোগ থাকলেও ‘ভবনে’ নেই কলাম কিংবা বিম। তার মধ্যেই থাকে ২২৬টি পরিবার।

রায়েরবাজার, কামরাঙ্গীরচর, কড়াইল, রামপুরায় আছে এমন শত শত বাড়ি। সবগুলোই দাঁড়িয়ে আছে পানির ওপর কিংবা ভরাট করা জলাশয়ের নরম মাটিতে। বস্তিবাসী হাজার হাজার মানুষ বাস করে এখানে। মালিকরা বিত্তবান। প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই হাজার ২০০ টাকা ভাড়ায় থাকে একেকটি দরিদ্র পরিবার। এই টাকার ভাগ পান দখলদার, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তাসহ সবাই।রায়েরবাজার কবরস্থানের ১ নম্বর গেটের ঠিক বিপরীতে বেড়িবাঁধের পাশ ঘেঁষে নিচু জমিতে কয়েক বছরে টিনের ঘর উঠেছে কয়েকশ’। দখলদারদের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে এসব ঘর তুলেছেন স্থানীয় কয়েকজন। তারাই ভাড়া আদায় করেন। সরেজমিনে গিয়ে তাদের দু’জনের খোঁজ পাওয়া যায়। একজন আমানউল্লাহ, অন্যজন রহমতউল্লাহ। দু’জনই জমি ভাড়া নিয়েছেন সাদেক খানের কাছ থেকে। পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া এক বিঘা জমিতে রহমতউল্লাহ ঘর তুলেছেন ৫৩টি। তাতে বাস করে ৫১টি পরিবার। সবাই নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘরের সামনে কথা হয় কাঞ্চন নামের এক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ঘরপ্রতি ভাড়া দুই হাজার ২০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি থাকেন দোতলায় ৪৩ নম্বর ঘরে। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে কাঞ্চনের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, দৈর্ঘ্যে ১০ ফুট, প্রস্থে আট ফুটের কামরা। নেই জানালা। আলো-বাতাসের জন্য রয়েছে মাত্র একটি দরজা। মাথার ওপরে টিনের ছাপরা। ঘরের সামনে করিডোর পেরিয়ে গণরান্নাঘর ও শৌচাগার। গ্যাস ও পানির অবৈধ সংযোগ আছে। হাঁটাচলা করলেও পুরো ঘর কাঁপে। মৃত্যুঝুঁকি জেনেও এই ঘরে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে এক বছর ধরে বাস করছেন কাঞ্চন। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ভালো বাড়িতে থাকতে গেলে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাগে। রিকশা চালিয়ে পেটের ভাতই জোগানো দায়। এত ভাড়া কীভাবে দেব। প্রতি মাসে রহমতউল্লাহকে ঘর ভাড়া দেন বলে জানান ভাড়াটিয়ারা। কাঞ্চন জানালেন, কয়েক দিন আগের ঝড়ে ঘর বারবার কেঁপে ওঠে। বড় ধরনের ঝড় হলেই এসব বহুতল ঘর ভেঙে পড়বে।

এই ঘরের বাসিন্দাসহ সামনের দোকানি ও স্থানীয়রা জানালেন, সরকারি জায়গার ওপর করা হয়েছে এসব ঘর। মাসে অন্তত আট লাখ টাকা ভাড়া আসে ২২৬টি ঘর থেকে। এর ভাগ পান সবাই। নাম প্রকাশ করে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। স্থানীয়রা নিশ্চিত করলেন, বেড়িবাঁধের পাশের প্রায় সব জমিই সরকারি। মাত্র ২৫ বছর আগেও খালে নৌকা চলত। পরে সাদেক খান ও তার ভাইয়েরা এসব জমি দখল করেন। তার ভাই মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি কাদের খান আসন্ন উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী।

দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেন সাদেক খান। তিনি দাবি করেন, জমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। বৈধ মালিকানা থাকলেও গ্যাস-পানির বৈধ সংযোগ নেই কেন_ এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘জমি রহমতউল্লাহকে ভাড়া দিয়েছি। সে কীভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ এনেছে জানি না।’ আইনে জলাশয় ভরাট করার বিষয়ে মানা থাকলেও তা না মানার প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই আইন থাকলে, ঢাকায় কোনো বিল্ডিংই করা যেত না। আইন মানে কয়জন।’ জমির মালিকানা দাবি করলেও বাঁশ দিয়ে বহুতল ঘর বানানো হয়েছে কি-না তা জানেন না বলে দাবি করেন সাদেক খান।

তিনি বলেন, ‘আমার চোখে এখনও পড়েনি। যদি কেউ এমন ঘর বানায় তাহলে ভেঙে দিতে বলব।’অভিন্ন চিত্র কড়াইলেও। মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলোনির পূর্ব পাশে গুলশান লেকের ওপর বাঁশ পুঁতে অন্তত একশ’ ঘর উঠেছে এ বস্তিতে। এ বস্তিতে ঘরের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। বাস করেন প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ। বস্তি থেকে এবারের নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী ফারুক রাজা এ তথ্য জানান।

কথা হয় ঘরের মালিক রবিউল ইসলামের সঙ্গে। বরিশাল থেকে এসে ১৯৯১ সালে ঘর করেন কড়াইলে। রবিউল জানান, প্রথমে কড়াইলে ঘর তোলা নিয়ে কোনো বাধা-নিষেধ ছিল না। ভূমিহীন ছিন্নমূল মানুষ ঝিলের পাড়ে ঘর তোলেন। পরে দখলদাররা সব জমি দখল করে নেয়। জমি শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন বাঁশ পুঁতে ঘর তুলছে লেকের ওপর। কারও কারও ঘরের সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০। এমনই একজন সোবহান মাওলানা। তার ঘর ১১০টি। মাসে ভাড়া পান তিন লাখ টাকা। ম্যানেজার মাসে মাসে ভাড়া নিয়ে যান। এসব ঘরে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ আছে। রবিউল জানান, গ্যাসের চুলাপ্রতি ৩০০ টাকা দিতে হয় ইউসুফ নামের বাস্তুহারা লীগ নেতাকে। পানির জন্য দিতে হয় ৫০ টাকা।

একাধিক বাসিন্দা বলেন, বস্তির ছয় হাজার ঘর থেকে মাসে ভাড়া ওঠে দেড় কোটি টাকা। টিঅ্যান্ডটি, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারী নেতারাও ঘরের মালিক। এ টাকার ভাগ নেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অনেকে। যে দল যখন ক্ষমতায় ঘর মালিকদের তাদের মাসিক চাঁদা দিতে হয়।লেকের পানির ওপর বাঁশের খুঁটি পুঁতে তৈরি ঘরে থাকেন আমেনা বেগম নামের এক নারী। গুলশানে বাসাবাড়িতে কাজ করেন তিনি। মাসে দুই হাজার ৮০০ টাকা ভাড়া দেন কাঠের পাটাতনের ১০০ বর্গফুটের ঘরের জন্য।রামপুরায় ঝিলের আড়াই কাঠা চারপাশ দখল করে টিনের দোতলা ঘর তোলেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনির চৌধুরী ও তার ভাই যুবদল নেতা টিনু চৌধুরী। এ ঘর দেবেই বুধবার মৃত্যু হয় ১২ জনের।

সরেজমিনে দেখা যায়, এমন ঘরের সংখ্যা অন্তত অর্ধশত। বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। ঘরের একাংশ মাটিতে; অন্য অংশ পানিতে কাঠের পাটাতনের ওপর। সমকাল



মন্তব্য চালু নেই