বছরজুড়ে আলোচিত পে-স্কেল
চলতি বছরের পুরো সময়জুড়ে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছে পে-স্কেল ছিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষীত ও আলোচিত বিষয়। পে-স্কেল নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নানাভাবে প্রশংসিত ও সমালোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের নানা দাবির মুখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন অর্থমন্ত্রী।
দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কাটছাঁটের পর গত ১৫ ডিসেম্বর গেজেট হওয়ার মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের বহুল প্রত্যাশিত অষ্টম পে-স্কেল পূর্ণতা লাভ করে। আগামী বছর জানুয়ারিতে সরকারি চাকরিজীবীরা নতুন পে-স্কেলে তাদের বেতন তুলবেন। আর পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এটা কার্যকর হবে চলতি বছরের জুলাই থেকে। বকেয়া পাঁচ মাসের বেতন দুই কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে বলে ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।
সপ্তম পে-কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের বেতন ও চাকরি কমিশন (অষ্টম কমিশন) গঠন করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৪ নভেম্বর। দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় ১৩ মাস পর তারা প্রতিবেদন দেন। অবশ্য কমিশন নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। ফলে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়।
এদিকে, ড. ফরাসউদ্দিনের বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদের জ্যেষ্ঠ সচিবকে আহ্বায়ক করে গত ১ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের এই কমিটি করে সরকার। অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কমিটির সদস্য ছিলেন।
সচিব কমিটি গঠনের প্রায় পাঁচ মাস পর তাদের সুপারিশসহ পে-স্কেল ১৩ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করে। সুপারিশে সরকারি চাকরিজীবীদের মূল মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়। ফরাসউদ্দিন কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনের ধাপ ১৬টি করার সুপারিশ করলেও সচিব কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বেতনের ধাপ ২০টিই বহাল রাখার সুপারিশ করে। তবে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না রাখার পক্ষে তাদের মতামত জানায়।
চাকরি কমিশন সর্বোচ্চ ৮০ হাজার ও সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২০০ টাকা মূল বেতন ধরে নতুন বেতন কাঠামোর সুপারিশ করে। সচিব কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা সুপারিশ করে।
এদিন অর্থমন্ত্রী বলেন, পে-স্কেল যখনই চূড়ান্ত হোক না কেন, এটি চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। দুই ধাপে এটা বাস্তবায়ন করা হতে পারে। আগেও তা-ই হয়েছে। এর আগের পে-স্কেলে ৬২ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছিল। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর বেতন ৮৭ থেকে ১০১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
নতুন কাঠামো কার্যকর করতে সরকারের বেতন বাবদ খরচ বাড়বে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের হাতে রয়েছে। এদিকে সচিব কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, চূড়ান্ত কাঠামো অনুযায়ী বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে যোগ দেওয়া একজন চাকরিজীবীর মূল বেতন হবে মাসে ২৫ হাজার টাকার বেশি। আগের কাঠামোতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মূল বেতন ছিল ১১ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০০৯ সালে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা হারে মূল বেতন পাচ্ছেন। এর সঙ্গে তারা পাচ্ছেন মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ্য ভাতা, যা ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের দিন থেকে এই মহার্ঘ্য ভাতা বিলুপ্ত হবে।
পে-কমিশন তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি সায়েন্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএইএসএ) এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিইএবি) প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে। এ দুটি সংগঠনই তাদের বেতনবৈষম্য তুলে ধরে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।
বিএইএসএর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি ড. মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। সংগঠনের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন সংগঠনের মহাসচিব ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, যথেষ্ঠ সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। মেধাবীরা নিজেদের উদ্যোগে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর ফিরছেন না। আর দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। এতে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। মেধাবী বিজ্ঞানীদের ধরে রাখতে হলে তাদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১২ বছরে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। অন্যদিকে পরমাণু শক্তি কমিশনের একই পর্যায়ে যেতে ২৫ বছর লাগছে। এ বৈষম্য দূর হওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনই দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে বিজ্ঞানী পদে যোগদানের জন্য আবেদন করতে এসএসসি থেকে এমএসসি পর্যন্ত ন্যুনতম তিনটি প্রথম বিভাগ থাকতে হয়। ১৯৭৩ সালে কমিশন প্রতিষ্ঠার পর দেশের মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রচলিত পে-স্কেলের অতিরিক্ত বেতন-বাতা দেওয়া হতো। ফলে দেশের সেরা মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান না করে কমিশনে বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিতেন।
তিনি বলেন, ড. ওয়াজেদ মিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন চাকরি বিধিমালা প্রণীত হওয়ার পর থেকে কমিশনের বিজ্ঞানীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনুরূপ বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধার কারণে কমিশনের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের ২৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের মতো গ্রেড-১ এ বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। এতে তারা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হন, তেমনই তাদের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিল করা হলে বিজ্ঞানীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
মেধাবীদের কমিশনে চাকরিতে আকৃষ্ট করার এবং তাদের ধরে রাখার জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা চালুর দাবি জানান নেতারা। এ বিবেচনায় কমিশনের বিজ্ঞানীদের জন্য ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিশেষ ভাতা চালুর দাবি করা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের ৯ম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে ৫ম গ্রেড, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ৪র্থ গ্রেড থেকে ৩য় গ্রেডে, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ৩য় গ্রেড থেকে ১ম গ্রেড এবং জ্যেষ্ঠ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১ম গ্রেড থেকে জ্যেষ্ঠ সচিবের গ্রেড দেওয়ার দাবি করেন তারা।
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইডিইবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এ কে এম এ হামিদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর কাছে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে আট দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হল- অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের ধাপ ২০টির পরিবর্তে ১৫ থেকে ১৬টিতে নির্ধারণ করা। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য চাকরির চার বছর পূর্তির পর সিলেকশন গ্রেড এবং ৮, ১২, ১৫ বছর চাকরি পূর্তির পর ১ম, ২য় ও ৩য় টাইম স্কেল প্রদান করা। পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঁচ বছর পূর্তিতে নির্বাহী প্রকৌশলী বা সমমানের পদে, আট বছর পূর্তিতে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পদে, ১৫ বছর পূর্তিতে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে, ২০ বছর পূর্তিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে এবং ২৫ বছর পূর্তিতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদের বেতন স্কেল প্রদান বা পদোন্নতির বিধান রাখা।
দুই সংগঠনের দাবির প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, অষ্টম পে-স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার আগে যেসব ক্যাডার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পেয়েছেন, তাদের এ সুবিধা বহাল রাখা হবে। এটা বাতিল করা হবে না। প্রজ্ঞাপন জারির আগে বাকি ক্যাডাররা সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল নিয়ে নিতে পারেন। তবে প্রজ্ঞাপন জারির পর সবকিছু নতুন নিয়মে চলবে।
তিনি বলেন, চাকরি যে গ্রেডে শুরু হয় সেটা ঠিক থাকবে। এটা পরিবর্তন করা যাবে না। বিশেষ প্রণোদনাও দেওয়া হবে না। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের কাজের এবং যোগ্যতার বিচারে নতুন কি করা যায়, সে বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই থাকবেন। কারো মর্যাদা ক্ষুণœ করা হবে না। নতুন বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকবে না। তবে এ দুটোর বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে, যাতে সবাই লাভবান হবেন।
সচিব কমিটির সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার পর তাতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষ করে, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনগুলো দাবির ভিত্তিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন বিভাগ থেকে নতুন বেতন কাঠামো ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে সেখানেও নানা অজুহাত দেখিয়ে দেরি করা হয়। এরই এক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হন। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো গেজেট হওয়ার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। আগামী জানুয়ারির মাসের বেতন হবে নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী। সরকারে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হবে।
বকেয়া বেতন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, চাকরিজীবীরা জানুয়ারিতে নতুন স্কেলে বেতন তুলতে পারবেন। আর এটা চলতি বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। তবে বকেয়া এক সঙ্গে দেওয়া সম্ভব হবে না। দুই দফায় বকেয়া পরিশোধ করা হবে। আর পুরো এক বছরের জন্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে।
জুলাই থেকে নতুন বেতন স্কেলে বকেয়া দুই কিস্তিতে দেওয়া হবে। প্রথম কিস্তিতে জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত এবং পরের কিস্তিতে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী শুধু চাকরিতে কর্মরতরাই লাভবান হবেন না, পেনশনভোগীরাও লাভবান হবেন। বিশেষ করে, অনলাইনে বেতন নির্ধারণ করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় দ্রুত সময়ের মধ্যে চাকরিজীবীরা নিজেরাই তাদের বেতন নির্ধারণ করতে পারবেন। একই সঙ্গে পেনশনভোগীরা তাদের পেনশন তুলতে গিয়ে যে হয়রানির শিকার হতেন, তা থেকে মুক্তি পাবেন। এখন থেকে আর তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। ব্যাংক থেকে সহজেই তারা পেনশন তুলতে পারবেন।-রাইজিংবিডি
মন্তব্য চালু নেই