বইয়ের ভাঁজে চ্যাপ্টা গোলাপ, ময়ুরপুচ্ছ পাখা

কিশোরীর পড়ার বইয়ের পাতার ভাঁজে শুকিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গোলাপ অথবা ময়ুরপুচ্ছ পাখা। অথবা কিশোর প্রেমিকের কাঁপা হাতে লেখা চিঠি- সেটাতে একটা লাইনও সোজা নয়, অজস্র বানান ভুল। কিন্তু প্রয়াসটা যে আত্মা ছোঁয়া তা প্রত্যেকটা লাইন যেনো ঘোষণা দিচ্ছে! কেউ কেউ তো রীতিমতো হাত কেটে রক্ত দিয়ে লিখতো। কখনো কখনো সুন্দর করে নকশা করা, চকমকি কাগজ বসানো আর জরি বিছানো কার্ডে ভরে পাঠানো হতো এসব চিঠি। আজকাল তো সব দু’নম্বরি হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা রঙ দিয়ে লেখে।

ঘটা করে দেখা করার চল ছিল না বললেই চলে। কারণ প্রেমিকাটা হতো হয় সহপাঠী অথবা প্রতিবেশী অথবা স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে পড়ে এমন কোনো বাড়ির। তাদের জন্য বিশেষ দিন বলতে সেই প্রথম দৃষ্টি বিনিময়। এরপরই ক্লাসে অথবা আসা যাওয়ার পথে দেখা। চারদিকে মানুষ, সঙ্কোচে, লোকলজ্জায় আড়ষ্ট, কেউ প্রকাশ্যে কথা বলে না। সবার ঘরে তখন টেলিফোন নেই, মোবাইল থাকার তো প্রশ্নই আসে না। দেখা হয় কথা হয় না। ভালোবাসা জানাবার একমাত্র ভরসা ‘ডাকপিয়ন’। সে হয়তো কোনো বন্ধু অথবা ছোট ভাইবোন। হঠাৎ একদিন সেই ভুলেভরা চিঠি বা চিরকুট বাবার হাতে পড়ে বেদম মার খাওয়া।

মাঝে মাঝে গ্রামের অদূরে ভাঙা ব্রিজের নিচে দেখা করা। অর্থহীন কথা গল্পে সন্ধ্যে নেমে আসা। আবছা অন্ধকারে দুরু দুরু বুকে কিশোরীর চুপে চুপে বাড়ি ঢুকে নিঃশব্দে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসা। মা খেতে ডাকার আগে পর্যন্ত বুক ধরফড় থামে না!

কিন্তু হয় না, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়ে ওঠে না। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় আগেই। অথবা দুই পরিবার থেকে মেনে নেয়া হয় না। মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে এই ক্লাসিক্যাল প্রেমের। কিশোরী সারা জীবন অচেনা বরের মাঝে কিশোর প্রেমিককে খুঁজে ফেরে। কোনো এক বিষণ্ণ বিকেলে একলা বারান্দায় বুক চিড়ে বের হয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস।

তবে বড়দের প্রেম হয় অন্যরকম। এসব পরিণত প্রেমে কিশোর বয়সের মতো রোমান্টিকতা থাকে না! এরা আকাশপাতাল ভাবে বলে মনে হয় না। আমাদের গ্রামে তো এমন সম্পর্ক জানাজানি হলে প্রায়ই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হতো। এতো তাড়াতাড়ি এমন একটা সম্পর্ককে হত্যা করা হতো যে সত্যিই খুব খারাপ ব্যাপার। অবশ্য সমাজতো এটাকে অবৈধই মনে করে সুতরাং চোখের সামনে এসব ফষ্টিনষ্টি চলতে দেবে কেন?

দুই হাজার পনেরো সালে এসে এসব আর ভাবতেই পারি না। ছেলেমেয়েরা ঘটা করে প্রোপোজ করে, কোনো রেস্টুরেন্টে অথবা পার্কে দেখা করে। এদের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। এরা আসলেই অনেক সাহসী। মেয়েরাও অনেক ‘ফরোয়ার্ড’!

এই ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই কতো কতো নতুন জুটি তৈরি হয়। নিয়ম করে পার্কে গিয়ে প্রেম করা, এখানে ওখানে ঘুরতে যাওয়া, কবিতা পড়া, গান গাওয়া, গাছের ফাঁকে অথবা সূর্য ডোবার পরে আবছা আলোতে গভীর করে চুমু খাওয়া- এসব চলে চুটিয়ে।

শুধু এটুকুতেই প্রেম থেমে থাকে না। প্রেম জানানোর পদ্ধতিতেও এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। বিকেলে প্রেম করে বাসায় ফিরে রাত ১২টার পরে শুরু হয় ফোনালাপ। মোবাইল অপারেটররা এই সুযোগটা নিয়ে নানা অফার ছাড়ে। কম পয়সায় রাত জেগে ফাও কথা চলে। এরপর সারা দিন মেসেজিং। দিবস উপলক্ষেও বিশেষ বিশেষ মেসেজ আদান প্রদান হয়। এটা কিন্তু চিঠি লেখার মতো নয়। এসব রোমান্টিক মেসেজও রেডিমেড পাওয়া যায়। বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে শুধু এসব মেসেজের। ফুটপাতে বইয়ের দোকানে রোমান্টিক মেসেজের বইও আজকাল পাওয়া যাচ্ছে।

অথবা ফেসবুকে চ্যাট। ইমোটিকন বিনিময়। স্কাইপে, ভাইবারে লাইভ আলাপ। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে দেখাদেখির ব্যবস্থা। অপেক্ষার মধুর যন্ত্রণা আর নেই।

এই প্রেমের বাড়াবাড়িটা আজকাল ভালোই জমেছে। এখানে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতীতে খুব একটা পার্থক্য হচ্ছে না। এতে হচ্ছেটা কী? আরেক ১৪ ফেব্রুয়ারি আসার আগেই হয়তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, এরা আবার নতুন জুটি খুঁজে নেয় বছর শেষে এই বিশেষ দিনে।

১৪ ফেব্রুয়ারি যতোটা প্রেমিক-প্রেমিকা বানিয়েছে তারচেয়ে বেশি করেছে প্রেমের বাণিজ্যিকীকরণ। সেই অর্থে বললে, এখন প্রেমের বাজার বেশ চাঙা! গোলাপ, ময়ুরপুচ্ছ পাখার দাম বেড়েছে কিন্তু আদর বাড়েনি।



মন্তব্য চালু নেই