ফুটবল জার্সি তৈরির কোটি টাকার ব্যবসায় ব্যস্ত কেরানিগঞ্জ

সেলাই মেশিনের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছেই। কোন দিকেই তাকাবার বিন্দুমাত্র সময় নেই। তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন মাপের জার্সি, গেঞ্জি ও প্যান্ট। মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য তারা দিনরাত খেটে সেলাইকল চালিয়ে যাচ্ছেন। আসন্ন বিশ্বকাপকে ঘিরে তাই তারা তৈরি করছে বিভিন্ন দেশের এবং নামকরা খেলোয়ারের জার্সি।

ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে পোশাক তৈরীর এমন ব্যস্ততার চিত্র এখন প্রতিদিনই চোখে পড়বে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন কারখানায়। আর কদিন পরেই ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। তারপর ফুটবল জ্বরে কাপবে গোটা বিশ্ব। যার ছোয়া থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ৩২ দেশের বিভিন্ন সমর্থক। সেই সব দেশের পতাকা শোভা পাবে বাড়ির ছাদ,উঠোন, রাস্তা, বাজার, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাদ, অফিস ও বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু শুধু পতাকা দিয়েই কি সাড়া? প্রিয় দেশের প্রিয় তারকার জার্সি গায়ে চড়িয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ না মাতানো পর্যন্ত চলবে এই প্রতিযোগিতা।

কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, ৩২ দেশের সমর্থকদের কথা মাথায় রেখেই জার্সি ও গেঞ্জি তৈরীতে এখন মহাব্যস্ত এখন জার্সি তৈরীর কারিগররা। দিনরাত সমান তালে তারা কাজ করছেন। তবে বেশি তৈরী করা হচ্ছে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পর্তুগাল, জার্মানী ও স্পেনের জার্সি ও প্যান্ট। কারখানায় জার্সি ও প্যান্টের জন্য প্রথমেই কাপড় এনে তা কেটে করা হচ্ছে প্রিন্ট। প্রিন্ট শেষে তা চলে যাচ্ছে ডিজাইন কারিগরের কাছে। তিনি ডিজাইন শেষ করলেই তারপর তা চলে যাচ্ছে কারখানায়। সেই ডিজাইন অনুযায়ী কেউ জার্সি তৈরী করছেন, কেউ তৈরী করছেন প্যান্ট। তারপর তা কেউ প্যাকেটজাত করে পাঠিয়ে দিচ্ছে শো রুমে। এভাবেই কয়েক স্তর পেড়িয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক জার্সি। সব শেষে এসব জার্সি ও প্যান্ট চলে যাচ্ছে দেশ ছাড়াও বিদেশের মাটিতে।

জানা যায়, এসব জার্সি তৈরীতে প্রায় ছয় মাস আগেই থেকেই প্রস্তুতি চলছে তাদের। প্রথমে জার্সি ও প্যান্টের জন্য ওয়েবসাইডে সার্চ দেয়া, তারপর তা বাছাই, ডিজাইন নামানো, সেই অনুপাতে কাপড়ের অর্ডার, কাপড় কেনা। এসব পোশাক চায়না ও বাংলা কাপড়ে তৈরি। মানসম্মত এসব জার্সি ও প্যান্ট খুবই উন্নত মানের বলে কারিগরদের দাবি।

রাবেয়া গার্মেন্টস কারখানার কাটিং মাস্টার রাজিব জানালেন, সে সাত বছর ধরে এ কাজ করছে। তাদের এ কাজ করতে হয় সারা বছরই। কেননা তারা গোটা বছরই জার্সি ও প্যান্টের কাজ করেন। এ পেশাটা কোন মৌসুমী পেশা নয় তাদের কাছে।

একই কারখানার কারিগর জাহাঙ্গীর আলম জানান, তারা দিনরাত কাজ করছেন। কারণ একটাই, তাদের বিশ্বকাপের আগের রাতেই সব কাজ শেষ করতে হবে। তারপর আবার অন্য কোন টার্গেট। চাহিদা ব্যাপক থাকায় তারা এখন কেউ কেউ ওভার ডিউটিও করছেন।

তার কাছ থেকেই জানা গেল প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বকাপ ছাড়াও টি টুয়েন্টির জন্য জার্সি ও প্যান্ট তৈরি করেছিল। তখন তারা ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় এবার ফুটবল বিশ্বকাপের এ বড় আয়োজনের জন্য প্রায় অর্ধ লাখের বেশি জার্সি ও প্যান্ট তৈরির টার্গেট তাদের। তারা ইতোমধ্যেই পঁচিশ হাজারের বেশি পোশাক দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করেছে। তাদের পোশাকের মান ও ফিনিশিং ভাল হওয়ার দরুন এসব জার্সি ও প্যান্ট দেশের মাটি পেড়িয়ে কোরিয়া ও জার্মানীতে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।

প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রতন শেখ জানান, তাদের এ কারখানায় প্রতিদিনই কাজ চলছে। এজন্য ৭০ জন কারিগর একসঙ্গে কাজ করছে। এবার ব্যাপক চাহিদার জন্য তারা হিমসিম খাচ্ছেন।

কারখানার মালিক হাজী মামুন শেখ জানালেন, তাদের জার্সি ও প্যান্ট রাজধানীর বিভিন্ন স্পোর্টসের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদাও অনেক। তারা যা তৈরি করেন তা খুবই ভাল মানের। এক পিচ পোশাক তারা বিক্রি করেন হাজার বারশ টাকায়। তবে এবার আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পোষাকই বেশি বিক্রি হচ্ছেন তারা।

তিনি আরও জানান, আর্জেন্টিনার জন্য তারা ৩০ হাজার ও ব্রাজিলের জন্য ২০ হাজার পিচ জার্সি তৈরী করছেন। বাকী সব অন্যান্য দেশের জন্য। বাকী ১৫ দিন। ইতোমধ্যেই অর্ধেকের বেশি জার্সি ও প্যান্ট তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেছেন।

কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ, কালিগঞ্জের নুরু মার্কেট ছাড়াও বাড্ডা, গুমদা, বঙ্গবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় এসব পোশাকের কারখানায় পুরো দমে কাজ চলছে। এসব পোশাক তৈরির পরই তা চলে যাচ্ছে সরাসরি দোকানে। সেখানেই দোকানিরা পাইকারী দরে বিক্রি করছেন দেশের বিভিন্ন খুচরা দোকানিদের কাছে।

গুলিস্তান ও বঙ্গবাজার ঘুরে দেখা গেছে, একটি জার্সি বিক্রি ৯০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তারপর তা খুচরা দোকানির হাতে বিক্রি হচ্ছে চারশ থেকে পাঁচশ টাকায়। তবে গুলিস্থান ও বঙ্গবাজারের যেসব কাপড় পাওয়া যাচ্ছে তার মান তেমন একটা ভাল নয় বললেই চলে।

বঙ্গবাজারের মেহেদী গার্মেন্টসের মালিক মেহেদী হাসান জানালেন,তারা এবার প্রায় ৭০ হাজারের মত ফুটবলের পোশাক তৈরির টার্গেট নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই অর্ধেকের বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনও কাজ চলছে।

তানভীর গার্মেন্টসের মালিক তানভীর হাসান বলেন, আমরা আমাদের কারখানায় যেসব জার্সি তৈরী করছি তা মুলত কম ও বেশি দামের। তবে দুই দামেরই জার্সি তৈরী করছি। কারণ একটাই, সবাই যেন সেই দলের জার্সি গায়ে দিতে পারে। এবার আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের চাহিদা বেশি থাকায় এই দুই দলেরই জার্সি বেশি তৈরী হচ্ছে।

কালিগঞ্জ, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার ছাড়াও এসব জার্সি ও প্যান্ট পাওয়া যাচ্ছে স্টেডিয়াম মার্কেট, গুলিস্তানের ট্রেড সেন্টার মার্কেট, নিউমার্কেটে, গুলশানের কিছু স্পোর্টস দোকানে। রাজধানীর ছোট বড় এসব কারখানায় প্রায় কয়েক লক্ষাধিক জার্সি ও প্যান্ট তৈরী হচ্ছে। এবার ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে প্রায় বিশ থেকে পচিশ কোটি টাকার শুধু জার্সি ও প্যান্ট বিক্রি হবে।



মন্তব্য চালু নেই