ফরিদপুরে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে ওরস শরীফ

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে মহা পবিত্র ওরস শরীফ আজ ১৫ই ফেব্রুয়ারি রবিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে মহা সমারোহে। চার দিনব্যাপী এ ওরস শরীফকে কেন্দ্র করে দেশ বিদেশের লাখো মুসলিম-হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে বিশ্বজাকের মঞ্জিল।

আজ রবিবার ওরস শরীফে হাজির হয়েছিলেন প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন ও তার ছোট ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলার উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার মোহত্শোম হোসেন বাবর, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী, পুলিশ সুপার মোঃ জামিল হাসান, জেলা আওয়ামীলীগের ত্রান ও সমাজ কল্যান সম্পাদক মোকারম মিয়া বাবু, জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক সত্যজিৎ মূখার্জী, কোতয়ালী থানা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক সামচুল আলম চৌধুরীসহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন দুই ঘন্টাব্যাপী ওরস শরীফের পীরজাদা আলহাজ খাজা মোস্তফা আমীর ফয়সল মুজাদ্দেদী ছাহেবের সাথে ধর্মীয় আলোচনা করেন। ওরস শরীফ উপলক্ষে বিশ্বজাকের মঞ্জিল সেজেছে বাহারি সাজে। এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের লাখো ভক্তের পদভারে মুখরিত গোটা আটরশি এলাকা। বিশ্বব্যাপী শান্তি, সাম্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বারতা ছড়িয়ে বিশ্ব ওলী হযরত শাহসুফী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:ছে:আ:) ছাহেবের বিশ্ব ওরস শরীফ প্রতি বছর শুরু হয় এ সময়।

হজ্জের পরে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক মহাসম্মেলনে তরিকায়ে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়ার তরঙ্গে চার দিনের আসা যাওয়ায় কোটিরও অধিক শান্তিকামী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়সহ নানা ধর্মের মানুষ সমবেত হবেন এ বিশ্ব ওরস শরীফে। শান্তিকামী মানবতার বিশ্ব মহামিলনমেলায় প্রকৃত ইসলামের উদার নৈতিক মানবিক মূল্যবোধে উৎসারিত আর্দশের আলোকে বিশ্ব ওলীর পবিত্র সংস্পর্শে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য সন্নিধান, রাসুলে পাক (সাঃ) এর পূর্ণ আনুগত্য অর্জন ও আদর্শ অনুসরণে নিজেকে সমপর্ণ, হৃদয়ের অশুভ প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে শুভ প্রবৃত্তি জাগ্রতকরণ এবং সৃষ্টির নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবনে ব্রতী হয়ার শিক্ষাই নিহিত রয়েছে বিশ্ব ওরস শরীফে। বিশ্বওলী কেবলাজান ছাহেব ১৯৫৩ সালে তৎকালীন অজপাড়া গাঁ আটরশিতে ওরস শরীফের সূচনা করেন।

এর আগে ১৯৪২ সালে তদীয় আপন মুর্শিদ উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল খাজা এনায়েতপুরী (কুঃ ছিঃ আঃ) ছাহেবের নির্দেশে প্রত্যন্ত পল্লী আটরশিতে আগমন করেন। সভ্যতা ও শিক্ষার আলো বঞ্চিত অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এ গ্রাম থেকেই প্রথমে বাংলাদেশ এবং পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী হেদায়েতের বাণী প্রচার করেন বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ ছিঃ আঃ) ছাহেব। বিশ্বওলীর পবিত্র সান্নিধ্যে এসে দেশ বিদেশের কোটি কোটি মানুষ আলোর পথের সন্ধান পেয়েছেন। নিজকে চেনা ও পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা এবং তদীয় প্রিয় হাবিব রাসুলে পাক (সাঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী হয়েছেন। আর তাই প্রকৃত ধর্ম বোধে উজ্জীবিত হয়ে কর্মমুখর পথচলা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা, পরমত সহিষ্ণুতা, সকল ধর্ম, মত, পথের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব, বহু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মহাসাম্য, দেশপ্রেম, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের চেতনায় রঙিন হয়ে আলোকিত মানুষ হওয়ার তথা বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠার প্রতিকী প্রদর্শনী বিশ্বওলীর বিশ্ব ওরস শরীফ। বিশ্ব ওরস শরীফে যোগদানের জন্য দেশ-বিদেশের মানুষের ঢল শুরু হয়েছে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, মাওয়া-কাওরাকান্দি, বরিশাল-খুলনা-ভাঙ্গা, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ-রাজবাড়ী, পিয়াজখালী-বলাশিয়া, চরনওপাড়া নৌপথ-সকল পথেই শান্তিকামী নারী পুরুষের অব্যাহত ঢল। আল্লাহ প্রেমী লাখ লাখ মুসল্লির ঐকতানে মুখরিত বিশ্ব জাকের মঞ্জিল। বিশ্বওলী কেবলাজান ছাহেবের আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি পীরজাদা আলহাজ খাজা মাহফুযুল হক মুজাদ্দেদী ছাহেব এবং পীরজাদা আলহাজ খাজা মোস্তফা আমীর ফয়সল মুজাদ্দেদী ছাহেব সমবেতদের দফায় দফায় সাক্ষাৎ ও বিশেষ নসিহত দান করছেন। এদিকে,শান্তিকামী মানবতার বিশ্ব মহামিলনমেলা উপলক্ষ্যে নান্দনিক সাজে সেজেছে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল।

আলোকমালা সজ্জিত তোরণ, সফেদ এলইডি ক্ষুদ্রাকৃতির বাতিতে সুবিশাল জামে মসজিদ এবং সুউচ্চ ৪ মিনার অত্যন্ত মনোরম ও নয়নাভিরাম সাজে সাজানো হয়েছে রাতে দেখামাত্র হৃদয়ে অবর্ণনীয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ৪ দিনের বিশ্বওরস শরীফে ওয়াক্তিয়া নামাজের সঙ্গে নফল ইবাদত বন্দেগী, তেলাওয়াতে কালামে পাক, দফায় দফায় মিলাদ মাহ্ফিল ও বিশেষ মুনাজাত, মোরাকাবা মোশাহেদা, জিকের আসকার, প্রকৃত ইসলামের সুমহান আদর্শ আলোকপাত করে ওয়াজ নসিহDSCN5189ত অব্যাহতভাবে চলছে।

আগামী ১৭ ফেবুয়ারি মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্বওলী কেবলাজান ছাহেবের পবিত্র রওজা শরীফ জিয়ারত ও আখেরী মুনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মূল ভেন্যুর ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এবাদত বন্দেগী, আহার, বিশ্রাম, চিকিৎসা সেবা, গাড়ি পার্কিং, অগ্নি নির্বাপণ, নিরাপত্তা ও যোগাযোগ সুবিধাসহ সার্বিক আয়োজনে ৫৮টি ডিপার্টমেন্ট একযোগে কাজ করছে। বিশ্বওলী কেবলাজান ছাহেবের আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি পীরজাদা আলহাজ্জ খাজা মাহফুযুল হক মুজাদ্দেদী ছাহেব ও পীরজাদা আলহাজ্জ খাজা মোস্তফা আমীর ফয়সল মুজাদ্দেদী ছাহেব সার্বিক কার্যক্রম তদারক ও পরিচালনা করছেন। অপরদিকে, খোদা অন্বেষীদের এবাদত, বন্দেগী ও বিশ্রামের জন্য বিশাল বিশাল প্যান্ডেল, অন্দর মহলে পর্দার আড়ালে ৫ লাখ মহিলার এবাদত বন্দেগী, আহার ও বিশ্রামের বন্দোবস্ত, বিদেশী মেহমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা সব মিলিয়ে অসাধারণ আয়োজন।

বরাবরের ন্যায় অন্য ধর্মাবলম্বী ৫ লাখ মানুষের জন্য নির্মিত পৃথক পৃথক বিশাল কম্পাউন্ডে যথারীতি মানুষের স্রোত। ভাত, গোসত ও ডাল রান্নার পৃথক পৃথক পাকশালা এবং কোরবানি শালায় প্রচন্ড ব্যস্ততা। বিশাল খাবার মাঠগুলোতে উচড়ে পড়া ভীড়। ২ লাখ মুসল্লির এক সঙ্গে খাবার মাঠে বসে খাবার খেতে পারছেন। ২ লক্ষাধিক কর্মী এ সব ডিপার্টমেন্টে শিফটওয়ারী নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া ওজু ও পয়ঃপ্রনালির জন্য পর্যাপ্ত পানি, ৪ হাজার টয়লেট এবং স্থানীয়দের উদ্যোগে আরো ৬ হাজার টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। নিরাপত্তায় ৩ শতাধিক সিসি টিভি ক্যামেরা, ৩৬টি আর্চওয়ে গেট, ৫ শতাধিক হ্যান্ড হেল্ড ম্যাটাল ডিটেক্টও ও সমসংখ্যক ওয়াকিটকি, ৪৮ টি অবজারভেশন পোস্ট, ২ হাজার সার্চ লাইট এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ৭৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া অগ্নি নির্বাপণে মোতায়েন রাখা হয়েছে দমকল ইউনিট। ৩২টি সুবিশাল কার পার্কিংয়ে ক্ষণে ক্ষণে নানা যানবাহনের ভীড়। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কয়েক হাজার কর্মী প্রবেশ সড়কগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন।

কাওরাকন্দি, বলাশিয়া, চন্দ্রপাড়াসহ ৪টি নৌ-বন্দরে নৌপথে আগত মানুষের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পসমূহে এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, মাওয়া-কাওরাকান্দি ফেরিঘাটে স্থাপিত ক্যাম্পসমূহে বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ করছেন আগতদের সহায়তায়। এছাড়া হেলিকপ্টার ওঠা নামার জন্য হেলিপ্যাডও রাখা হয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে ৫০০কিলোওয়াটের ১০টি জেনারেটর স্ট্যান্ডবাই রয়েছে। ২ সহস্রাধিক লাউড স্পীকার ও সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে চলছে এবাদত বন্দেগী, ওয়াজ নসিহতের কাজ। জরুরী চিকিৎসা সেবা সুনিশ্চিত করতে হাসপাতাল, ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিট ও এম্বুলেন্সও রাখা হয়েছে। এছাড়া মিডিয়া সেন্টার ও বিপুল সংখ্যক বুক স্টল রয়েছে।

অন্যদিকে, আল্লাহর মেহমানদের বরণে সড়ক পথগুলোতে জায়গায় জায়গায় এলাকাবাসী সরবত, গাছের ডাব, মিষ্টান্ন ও তৈরি করা নানা খাবারে আপ্যায়ন করছেন। প্রস্তুত রয়েছেন মেহমানদের স্থান সংকুলানে নিজের বাড়িতে জায়গা করে দিতে। বছর ঘুরে অবারিত রহমত, বরকত ও নিয়ামতের বারিধারা নিয়ে হাজির হয়েছে বিশ্ব ওরস শরীফ। তাই দেশ বিদেশের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের চোখ এখন বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে। বিশ্ব ওলীর বিশ্ব ওরস শরীফে।



মন্তব্য চালু নেই