পড়ন্ত বেলায় দুর্দিন, ম্যাডামের সামনে যত চ্যালেঞ্জ
বয়স ৭০, বিধবা হয়েছেন ৩৬ বছর বয়সেই। অবুঝ দুই ছেলেকে নিয়ে পথচলা শুরু। এরপর নিয়তির ডাকেই রাজনীতিতে আসা। দলে স্বামীর শূন্যতা পূরণে নেতানেত্রীদের অনেকটা পীড়াপিড়িতেই সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে অনেকটা হঠাৎ করেই রাজনীতির মাঠে আসেন। একদিকে অবুঝ দুই শিশু সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার; অন্যদিকে স্বামীর হত্যাকারী জেনারেল এরশাদকে উৎখাতে মাঠের রাজনীতি। এরপরও স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বেগম জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বেই ’৯০-এর পটপরিবর্তন ঘটে। দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়ার পরও জিয়ার ইমেজ আর তাঁর আপোষহীন অসাধারণ নেতৃ্ত্বের আকৃষ্ট হয়ে মানুষ বিএনপিকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। এরপর আরো দুইবার ক্ষমতায় বসেন বেগম জিয়া।
সাংবাদিক মাহফুজ আনামের ভাষায়- সেই সময়টা খালেদা জিয়ার জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত’। “এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়টি যদি বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে ‘শ্রেষ্ঠ সময়’ হয়ে থাকে তবে পরবর্তীতে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘অন্ধকার সময়’। আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি খালেদা জিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনভাবে চিন্তার মাধ্যমে পরিস্থিতির মূল্যায়ন, দ্রুত সমন্বয় এবং বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হন। এর অন্যতম উদারহরণ প্রধানমন্ত্রীর ফোনের বিষয়টি এবং নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠনে সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়া।”“এর শুরুটা হয় ২০০৮ এর নির্বাচনকে দিয়ে। ওই নির্বাচনের পরাজয়কে জনগণের রায় হিসেবে না মেনে তাকে তথাকথিত ‘১/১১ সরকারের’ মেকানিজম হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। এমনকি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকার চালানোর সময় তার ছেলে যে ভুল করেছেন তা তিনি পর্যালোচনা করেননি।”
থাক এসব তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কথা। এবার আসি মূল আলোচ্য বিষয়ের দিকে ১৯৮১ থেকে ২০১৫ এই ৩৫ বছরে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে জিয়া পরিবারকে। চড়াই-উৎরাই পাড় করতে হয়েছে তাকে। এরশাদের শাসনামলে ’৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় তাকে চরম জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অতঃপর ২০০৭ সালের ১/১১ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়। দুই ছেলেকেও পাঠানো হয় কারাগারে। ছেলেদের উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।
এরপরও খালেদা জিয়া এমন একজন রাজনীতিক। কখনো ক্ষমতায় থেকেছেন আবার কখনো বিরোধী দলে থেকেছেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নেই, নেই সংসদেও। না থাকলে কী হলো, দেশের জনপ্রিয় দলগুলোর অন্যতম বিএনপির চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী। দেশের মানুষের ‘ভোটের অধিকার’ আদায়ের দাবিতে তার নেতৃত্বে চলছে ৮ বছর ধরে আন্দোলন। মূলত জনগণকে ঘিরেই তার সব কিছু। কিন্তু এখন তাঁর জীবনে চরম দুর্দিন চলছে।
সরকার বিরোধী আন্দালনের মধ্যেই গেল ২৫ জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো নির্বাসনে থাকাবস্থায় মারা যান। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ২৭ জানুয়ারি লাশ দাফন করা হয়। আর বড় ছেলে তারেক রহমান সেই ২০০৮ সাল থেকেই স্বপরিবারে নির্বাসনে রয়েছেন। ২০০৯ সালের মে মাসে ৪০ বছরের স্বামীর স্মৃতি বিজরিত বাড়ি ছাড়া হয়ে উঠেছেন ভাড়া বাসায়। এখানেই শেষ নয়, খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে ২৬টি মামলা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫টি এবং তারেক রহমান ১৭টি ও কোকো ৭টি মামলার আসামি। কোকোর মৃত্যুর পর তার নাবালিকা দুই কন্যাকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। এগুলো অবশ্য জিয়ার পরিবারের জন্য নতুন কোনো কিছু নয়।
১৯৮১ থেকে ২০১৫ এই ৩৫ বছরে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে জিয়া পরিবারকে। চড়াই-উৎরাই পাড় করতে হয়েছে তাকে। এখন চরম দুর্দিন চলছে। ফলে সামনের দিনগুলো আরো বেশী চ্যালেঞ্জের মুখে এই পরিবারটি। এবার দেখে নেয়া যাক- ম্যাডামের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ-
এক. বিগত ‘১/১১ সরকারের’ আমলে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা হলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অপর নেত্রীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) সব ক’টি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ৫টি মামলার মধ্যে ম্যাডাম জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলার বিচার কাজ বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো এসব মামলার রায় হবে। এতে কী ধরনের সাজা হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে ক্ষমতা নয়, স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি করা এবং বাকী জীবন মুক্ত অবস্থায় জীবনযাপন করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে ম্যাডাম জিয়ার জন্য।
দুই. ৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, এই সময়ে রাজনীতির মাঠে বহু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান ফলাফল শূন্য। ফলে প্রচলিত রাজনীতিতে এখন কোনো কর্মসূচি দিলেই যে ফলাফল আসবে তার কোনো সম্ভাবনা আপতত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে রাজনৈতিকভাবেই জোট, দল ও নেতাকর্মিরাও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
তিন. দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও এদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী জিয়া পরিবারকে ভালবাসে এবং জিয়াউর রহমানের গড়ে যাওয়া দলটিকেও সমর্থন করে। তবে ৮ বছর ধরে জিয়ার পরিবারের সাথে সাথে অনেক জেলজুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এর অসংখ্য নেতাকমি ও সমর্থক। প্রতিকূল পরিবেশে এখনো তা অব্যাহত আছে। অনেকে গত কয়েক বছর থেকেই ফেরারি জীবন যাপন করছেন। আবার অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে কারা ভোগ করছেন। ফলে এই বিশাল কর্মী বাহিনীর এখন কী হবে। ম্যাডামকে নিজ পরিবারের সদস্যসহ জুলুম-নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদেরকেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটাও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চার. রাজনীতির মাঠে গড়া হয়েছে ২০ দলীয় জোট। রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশে জোট থাকবে কী থাকবে না। আর থাকলেই বা কীভাবে জোটটি টিকে থাকবে আর জোটের আন্দোলনই বা কীভাবে পরিচালিত হবে সেটাও এখন বড় প্রশ্ন। বলা যায়- স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জোট টিকিয়ে রাখাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
পাঁচ. সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়ে যাওয়া বিএনপি একটি বিশাল দল। রাজনীতির মাঠে সারাদেশে এর বিশাল কর্মিবাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশের সমর্থন। এই বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ । এক্ষেত্রে অনেকেই মনে করেন, দলের এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় দলে একটি গবেষণা সেল তৈরি করা জরুরী। যারা দেশব্যাপী সাধারণ জনতার মধ্যে থেকে রেন্ডাম স্যাম্পলিংয়ে গবেষণা জরিপ চালিয়ে একটা নতুন রাজনীতির ধারা সৃষ্টির জন্য তথ্য তুলে আনতে সক্ষম হবে। জনগণ কী চাচ্ছে আর কি চাচ্ছে না তা উঠে আসবে সেই গবেষণায়। কিন্তু ‘কে বাঁধবে বিড়ালের গলায় সেই ঘন্টা?’ তবে এ ধরনের একটা গবেষণা পরিচালনা করাও দলের জন্য চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করেন অনেকে।
ছয়. রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে চাটুকররা প্রশংসার বুলি উড়িয়ে নিজেরাই ম্যাডামকে ঘিরে রাখে, এতে মাঠের নেতাকর্মি ও সাধারণ জনগণ কী ভাবছেন সেটা জানা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ম্যাডামকে। এছাড়া দলের প্রভাবশালী নেতারাও নিজেদের ও সম্পদ রক্ষায় সরকারের সাথে গোপন আঁতাতে ম্যাডামকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেছেন। ফলে ম্যাডামকে এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজেকেই দলের নীতিনির্ধারণ করা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েঁছে।
সবমিলেই মামলা মোকাবেলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা, এই বিশাল নির্যাতিত কর্মীবাহিনীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং বিশলা জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে রাখতে ইতিবাচক রাজনীতি ধারায় এগুতে হবে ম্যাডামকে। অতীতে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, এরপরও দৃশ্যমান কাঙ্খিত ফল আসেনি । ফলে দলের গণতান্ত্রিক ইতিবাচক ধারা কর্মসূচিতেই আশা করা যায়- সরকার এক সময় নমনীয় হতে বাধ্য হবে। আর এতে নেতাকর্মিরাও মামলা-হামলা থেকেও তারা বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।
এদিকে গুলশান কার্যালয় থেকে তার বাসায় ফেরা এবং সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো নিয়ে চলছে নানান গুঞ্জন। মন্ত্রী এবং সরকারের স্তবক বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ খালেদা জিয়াকে ‘পরাজিত’ হিসেবে প্রচার করছেন। বিএনপির কিছু নেতা এটাকে ‘কৌশল’ মনে করলেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিএনপির রাজনীতি ‘শেষ হয়ে গেল’ এমনও রব তোলা হচ্ছে।
সবমিলেই হিসাব নিকাশের সময় এসেছে। স্বামীর ৪০ বছরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ছাড়া হয়ে, পুত্র হারানোর শোক এবং কঠিন দুর্দিনে ম্যাডাম জিয়ার চোখের পানিও যাদের আন্দোলনের মাঠে নামাতে পারেনি। দলের যারা অতীতে অনেক আখের গুছিয়েছেন আন্দোলনের সময় তাদের ভূমিকা কী ছিল? মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য নিত্যদিন যারা ছক আঁকেন এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ আকড়ে রয়েছেন বছরের পর বছর; তারা আন্দোলনের সময় কোথায় ছিলেন, তারা কী করেছেন। সেসব বিষয়ও বিবেচনা নেয়ার সময় এসেছে। ফলে দল এবং দেশের স্বার্থেই ম্যাডামকে এখন বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুতে হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আগামী দিনে ম্যাডাম কোন পথে হাটেঁন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সামনের পথ যে একেবারেই মসৃণ হবে সেটা বলার উপায় নেই।
কলাম লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য চালু নেই