প্লিজ, ম্যাডামকে একটু হাঁটতে দিন, ‘তিনি হাঁটলে গণতন্ত্র হাঁটবে’
তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নির্বাচন নিয়ে টান টান উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সহিংসতার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার একটা প্রাথমিক আলমত লক্ষ্য করা গেছে গত কয়েকদিনে। বেশ কয়েকবার হামলা হয়েছে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে। এসব ঘটনা সহিংসতার আশঙ্কাকে আরো স্পষ্ট তুলেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা যেন আমাদেরকে এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে সামনের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগ শুধু দেশবাসির মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা না দেয়া এবং গণতান্ত্রিক আচরণ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যতটুকু জানি তাতে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতা। গণতন্ত্র তো হলো সেই পরিবেশ- যেখানে সব দল মত ও বিশ্বাসের মানুষ তাদের সব চিন্তা-চেতনা মুক্তভাবে প্রকাশ ও চর্চা করতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজে যেমনটি কারো মত প্রচারে বাধার সৃষ্টি করা যায় না, তেমনি কোনোভাবেই কাউকে আঘাত তো দূরের কথা, অসম্মান করাও যায় না। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে হলে নিজেদের মত নিজেদের মতো করে জনগণের কাছে উপস্থাপনের মাধ্যমেই করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ব্যত্যয় হবে, সমাজ হারাবে গণতান্ত্রিক চরিত্র। ঘটবে গণতন্ত্রের বিপর্যয়। সমাজে প্রভাব বিস্তার করবে পেশিশক্তি।
আজ বাংলাদেশ কী সে পথেই এগুচ্ছে? আমরা গত তিন মাস ধরে কী দেখলাম। সরকার ও বিরোধী পক্ষ গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিবর্তে এক বিরাট শক্তির মহড়া দিয়েছে। দু’পক্ষের এই শক্তির প্রতিযোগিতায় প্রাণ গেল নিরপরাধ মানুষের, বোমার আগুণে পুড়ে মরলো, পুলিশ-র্যাবের গুলিতে মরলো, পঙ্গু হলো শত শত মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হলো হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এসব কেন হয়েছে, অবশ্য এর জবাব হাসিনা-খালেদার কাছে ভিন্ন। তবে আমরা জনগণ জানি, এসব কিছুর দায় তারা কেউ এড়াতে পারবেন না। কিন্তু তাতে আমাদের কী বা করার আছে!
রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা বলে কথা। যখন যার হাতে তখন তারা নিজের মতো করেই এই শক্তিকে ব্যবহার করেন। আর সেই শক্তির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সাধ্য কার বা আছে!
অন্যথা আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে বিশ্বাস করি- তবে জানুযারি মাসের প্রথমার্থে দেশের প্রধান বিরোধি ২০ দলীয় জোট যখন ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির ডাক দিলো। সরকার সেটা পালন করতে দিলো না, বরং জোটনেত্রী বেগম জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো গুলশান কার্যালয়ে। এরপর বিরোধি জোট ডাক দিলো অনির্দিষ্ট হরতাল-অবরোধের। পরবর্তীতে যা হবার তাই হলো। আমার মতো অনেকের চিন্তা- ওই সময় সেই কর্মসূচি তাদের পালন করতে দিলে সরকারের কী বা ক্ষতি হতো। কিন্তু সেটা করতে না দেয়া এবং ম্যাডামকে অবরুদ্ধ করে রাখার ফলে আমরা কী দেখলাম- জনগণ ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ হলো, গোটা দেশ অচল হলো। গণতান্ত্রিক রীতিতে যা সহজেই এড়ানো যেত।
এরপর অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক কৌশলেই দেশের পরিস্থিতিটা শান্ত হলো। রাজনীতিতে কৌশল অবলম্বন করা দোষের কিছু না। তবে সেটা হতে হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে। আমরা দেখলাম- ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই জাতীয় রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রায় তিন মাস ধরে বিরোধী জোটের যে রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল, এরই মধ্যে সেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ২৪ মার্চ, ২০১৫ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন কর্মসূচি তিন সিটিতে হরতাল স্থগিত করা হয়। এছাড়া পুরো আন্দোলনও অঘোষিতভাবে স্থগিত করার ইঙ্গিত মিলে জোটের পক্ষ থেকে। ফলে বলা যায়-সব দলই এখন নির্বাচনমুখী।
যদিও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন, এ নির্বাচনের সাথে জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, তবুও এই নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো কমতি নেই। আগের রীতি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচন রাজনীতির বাইরে থাকার কথা। কিন্তু এবার তা হয়নি। পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়- এ নির্বাচন এখন পুরোটাই রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। শুধু জাতীয় রাজনীতির প্রতীক নেই, আর সবই আছে এতে। কেননা, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেখানে প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন সেখানে আর রাজনীতিকরণের বাকী থাকে কোথায়?
এখানেই শেষ নয়, এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। উভয়েই এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই চ্যালেঞ্জ আবার নাগরিক সেবা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ নয়, জেতার চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য নেতাকর্মিদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন । অন্যদিকে বিরোধী জোটের রাজণৈতিক গুরু হিসেবে পরিচিত পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক ইমাজ উদ্দীন আহমেদ বলেছেন, এই নির্বাচনে জিততে না পারলে বিরোধীদের আরো বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এছাড়া বিরোধী জোটের নেত্রীসহ অন্যান্য নেতাদের কথা-বার্তায়ও এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
এরই প্রেক্ষিতে গত কয়েকদিন আগে থেকে ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামেন। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে যে কোনো নির্বাচনে সকলের অংশগ্রহণ একটি সুন্দর নির্বাচনের পূর্বশর্ত। সে হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। এতে সিটি নির্বাচন অনেকটাই অলংকৃত হয়েছে। এছাড়া বেগম জিয়ার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনী শর্ত পূরণ হয়েছে। সিটি নির্বাচনের প্রচারণায় খালেদা জিয়া মাঠে নামায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য তিনি সবার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ পেতে পারেন।
কিন্তু আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে গত সোমবারের ও বুধবারের ঘটনা। এর আগে রোববার কালো পতাকা প্রদর্শন, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও সোমবার কাওরানবাজারে তিন তিনবারের নির্বাচিত সাবেক খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার গাড়ি বহরের তিনটি গাড়িসহ অন্তত ১০ টি যানবাহন ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় বুধবার বিএনপি হরতাল পালন করে। এরপর বুধবার বিকালেও রাজধানীর বাংলামোটরে তার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা পুলিশের চোখের সামনে ঘটলেও অনেকটা নির্বিকার দেখা গেছে। এছাড়া হামলার পর জড়িতদের গ্রেপ্তার না করে উল্টো খালেদা জিয়ার নিরাপত্তারক্ষী ও বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব হামলাকে জনরোষ ও নাটক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- বেগম জিয়াকে পুনরায় ঘরের ভেতরে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর বাস্তবে যদি সেটাই করা হয় তবে কী ঘটবে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।
এ কথা সবারই জানা, আমরা যতই দুই নেত্রীকে দোষারোপ করি না কেন, দেশের বেশীর ভাগ জনগণ কিন্তু তাদের ছায়াতলে। ফলে দুই নেত্রীর প্রতি রয়েছে দেশের জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের জনসমর্থন। ফলে ইচছা করলেই কেউ কাউকে দমাতে পারবে না, এটাই বাস্তবতা।
ফলে যে অবস্থা চলছে তা অব্যাহত থাকলে বলা যায়- অঘোষিতভাবেই বেগম জিয়া ঘরে না হয় কার্যালয়ে আবারো আবদ্ধ হয়ে পড়তে পারেন। আর এতে করে কী হবে- আবারো দেশে ফিরে আসবে সেই পুরনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং হরতাল অবরোধ।
তাই মনে পড়ে গণতন্ত্র সম্পর্কে আব্রাহাম লিংকনের সেই কথা ‘By the people, of the people and people’। ফলে আমরা যদি গণতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রাখি তবে সবাইকে সেই চর্চা করার সুযোগ দেয়া উচিত। সবশেষে, আমি সরকারের প্রতি আহবান রাখবো- দয়া করে ম্যাডাম জিয়াকে নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে দিন। তিনি হাঁটলে, গণতন্ত্র হাঁটবে, তিনি রাস্তায় চলতে পারলে দেশের সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলবে। অন্যথা, তিনি ঘরে আবদ্ধ হয়ে গেলে আমরাও আবদ্ধ হয়ে যাবো। কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ আর আবদ্ধ হতে চাই না। প্লিজ, ম্যাডাম বাধা দিবেন না। তাঁকে নির্বিঘ্নে চলতে দিন।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক।
ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য চালু নেই