প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরে গুরুত্ব পাবে ট্রানজিট ও হাইড্রোপাওয়ার

রাষ্ট্রীয় সফরে আগামী ৭ এপ্রিল ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত থেকে ফেরার পর ১৯ এপ্রিল দ্বিপাক্ষিক সফরে ভুটান যাবেন তিনি। তার এই সফরে দুদেশের মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ও হাইড্রোপাওয়ার সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে।

একই সঙ্গে দু-দেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অটিজম বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশ্বস্ত সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, মূলত দ্বিপাক্ষিক সফরে ভুটান যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সফরের আনুষ্ঠানিক ইস্যু অটিজমবিষয়ক ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার ভুটান ২০১৭’শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর যোগদান। বাংলাদেশ ও ভুটান যৌথভাবে এই সম্মেলন আয়োজন করছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভুটানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের কার্যালয়, সূচনা ফাউন্ডেশন এবং অ্যাবিলিটি ভুটান সোসাইটি এ সম্মেলনের আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত হবে অটিজম বিষয়ক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন।

এর বাইরে বাংলাদেশের আগ্রহের প্রেক্ষিত্রে সফরে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং হাইড্রোপাওয়ার সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। এছাড়া এ সফরে ভুটানের সঙ্গে বেশকিছু চুক্তি ও সমঝোতা হতে পারে। বর্তমানে সেসব নিয়ে কাজ করছেন দুদেশের কর্মকর্তারা।

প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভুটানের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান ট্রানজিট ও বাণিজ্যের নামে এসব অঞ্চলে বাণিজ্যিক সর্ম্পক বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১১-১২ সালে ভুটান থেকে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ ২ কোটি ৭ লাখ ডলার। ভুটানে রপ্তানি হয় ২০ লাখ ২৬ হাজার ১২০ ডলার। ২০১২-১৩ সালে ভুটান থেকে আমদানির পরিমাণ ২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এবং রপ্তানি ১৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৪ ডলার। ২০১৩-১৪ সালে ভুটান থেকে আমদানির পরিমাণ ২ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং রপ্তানি হয় ১৯ লাখ ডলার।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে বাণিজ্যিক সর্ম্পক বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ বলেন, এখনো প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পণ্যের চলাচল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। অনেক সময় এগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতারও শিকার হয়। এসব দেশের মধ্যে পণ্যের নিরবিচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করা গেলে উন্নতি আরো ত্বরানিত হবে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পণ্য চলাচলে কখনো কখনো এক মাসের মতোও সময় লেগে যায়, পার হতে হয় প্রায় দশ-পনেরোটা ধাপ। এসব করিডোরের সবকটিতেই পণ্য চলাচলে নানা ছাড়পত্র পেতে অনেক দেরি হয়। আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয় পক্ষকেই জোগাড় করতে হয় অনেক নথি ও কাগজপত্র।

নেপালের কাঁকড়ভিটা থেকে বাংলাদেশের ফুলবাড়িতে একটা পণ্য রপ্তানি করতে ৭৪টি নথি লাগে। শুধু এতগুলো ডকুমেন্টই নয়, এসবের অনেক ফটোকপিও লাগে, সামলাতে হয় অন্তত ১৪/১৫ জন অফিসারকে। সব মিলিয়ে ট্রাকচালক ও কাস্টম হাউস এজেন্টদের হিমশিম খেতে হয়, এক জায়গাতেই প্রচুর সময় লাগে।

দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে একটি গাড়ির ব্যাটারি নেপালে রপ্তানি করতে গড়ে লেগে যায় ২৯ দিনের বেশি, খরচও পড়ে অস্বাভাবিক বেশি। অথচ এই করিডোর মাত্র ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা পাড়ি দিতে ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এসব সমস্যার সমাধানে ডিজিটাল কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারত ইতোমধ্যে যথেষ্ট এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ রয়েছে অনেক পিছিয়ে।

গবেষণাপত্রে আরো দেখা যায়, ভুটান থেকে বাংলাদেশের ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য কমলালেবু আসে বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে। এখানকার হ্যান্ডলিং চার্জ বেশি। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাবান্ধা সীমান্ত করিডোরের ফুলবাড়ী বাদে বাকি তিনটি স্থলবন্দরে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ব্যবস্থা নেই। পণ্যবাহী ট্রাক রাখা ও পণ্য সংরক্ষণের পর্যাপ্ত গুদামও নেই।

নেপাল, ভুটান ও ভারতকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারের একটি কমিটি ৯টি সড়কপথ, ৯টি রেলপথ ও ৫টি নৌপথ শনাক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের আগে এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ও ভুটানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেছেন। আশা করা হচ্ছে, সফরকালে এসব বিষয় চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা পাবে।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘ট্রানজিট ইস্যুগুলো নিয়ে ২০১০ সাল থেকেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়ে আলোচনা যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আমরা আশা করছি, দেশটির সঙ্গে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরেই তা হতে পারে বলেও তিনি ইঙ্গিত করেন।

প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানী ও বিদ্যুৎ খাত বিশেষ করে হাইড্রোপাওয়ার খাতে বিনিয়োগ বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের বিষয়েও আলোচনা হবে। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটান সফরকালে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট, সাফটার আওতায় এবং যৌথ-বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্প্রসারন বিষয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

এদিকে আগামী ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সঙ্গে প্রাধান্য পাবে ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ইস্যুও। ভারতের অভিজ্ঞার আলোকে ভুটানের সঙ্গেও এসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলেও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ভাবে চূড়ান্ত হওয়া সফরসূচী অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ থেকে ২১ এপ্রিল ভুটান সফর করবেন।



মন্তব্য চালু নেই