পুনঃশুনানি হবে দুই বিচারপতির রায়

সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরের পর যে রায়গুলো লিখেছেন বা লেখার অপেক্ষায় রয়েছে, এমন ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে রয়েছে ১৬১টি মামলা। বাকি সাতটি মামলা আছে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের কাছে। বেশিরভাগ মামলার রায় লেখার কাজ শেষ করেছিলেন ওই দুই বিচারপতি।

কিন্তু তাদের লেখা রায় ‘গ্রহণযোগ্য’ না হওয়ায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মামলাগুলো পুনঃশুনানির নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছে এসব মামলার (পেপারবুক) নথিপত্র।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘২৬ এপ্রিল এসব মামলার পুনঃশুনানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের অবকাশের পর আগামী সোমবার থেকে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম চলবে। ওই দিনের দৈনন্দিন কার্যতালিকাতেই মামলাগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা।

একশত ৬১টি মামলার মধ্যে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের এক নম্বর আদালতের কার্যতালিকায় ১০০টি এবং বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর আদালতের কার্যতালিকায় বাকি মামলাগুলো পুনঃশুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

২০১৫ সালের এক অক্টোবর আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অবসরে যাওয়ার সময় ১৬১টি মামলার রায় লেখার দায়িত্ব ছিল এই বিচারপতির। অবসরে যাওয়ার আগেই আপিল বিভাগে বিভিন্ন সময়ে মামলাগুলোর শুনানি সম্পন্ন হয়। অবসরের আগে মামলাগুলোতে সংক্ষিপ্ত আদেশও জানিয়ে দেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। শুধু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ বাকি ছিল। মামলাগুলোর রায় দীর্ঘদিনেও তিনি না লিখে কালক্ষেপণ করছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আর এমনই এক পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা গত ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে অবসরের পরে রায় লেখাকে সংবিধানপরিপন্থি হিসেবে উল্লেখ করেন।

ওই বাণীতে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন সময় ধরে রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থি।’

অবসরের পর রায় লেখা ‘বেআইনি’ বলার ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা তার বাণীতে বলেন, ‘কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন। বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।’

এরপর গত ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর আর কোনো রায় লিখতে দেয়া হবে না। আমাদের দেশে অতীতে এ রকম রায় দিলেও এখন থেকে আর এ সুযোগ দেয়া যাবে না।’

এরপর তীব্র সমালোচনার মুখে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৬৫টি মামলার রায় ও আদেশের কপি হাতে লিখে জমা দেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি আরো কিছু রায় লিখে জমা দেন। বিচারপতি মানিক তার কাছে আর কোনো মামলায় রায় লেখার কাজ বাকি নেই বলে তখন মিডিয়ার কাছে দাবি করেছিলেন।

তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আরো কিছু মামলার রায় লেখার অপেক্ষায় ছিল। আর যেসব রায় তিনি হাতে লিখে জমা দিয়েছেন, সেগুলোর অনেক লেখাই অস্পষ্ট। পাশাপাশি আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ থেকে এসব মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, সেই বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা এখনও এসব রায়ে স্বাক্ষর করেননি।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো মামলার রায় লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি রায়টি লেখার কাজ শেষ করার পর অন্য বিচারপতিরা তা দেখে একমত হয়ে স্বাক্ষর করেন। আর বেঞ্চের সব বিচারপতির স্বাক্ষর শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি রায় হিসেবেও গণ্য হয় না।

যেসব মামলা পুনঃশুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এগুলোর মধ্যে ২০১৩ সালে রায় ঘোষণা করা হয়েছে এমন মামলাও রয়েছে। এছাড়াও অবসরের পরে লেখা রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি সবগুলো মামলারই পুনঃশুনানির আদেশ দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এসব মামলায় রায় ঘোষণার পর আবারো পুনঃশুনানির উদ্যোগ নেয়ায় বিচারপ্রার্থীদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হবে, সময় ও অর্থের অপচয় হবে। তারপরও রায়গুলো আইনসিদ্ধ করতে ও বিতর্ক এড়াতে প্রধান বিচারপতি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গা বাঁচানোর জন্য কেউ দায়সারা রায় লিখে থাকলে তা অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তবে একজন বিচারপতির গাফিলতির কারণে যদি রায় লেখা না হয় বা পুনঃশুনানি করতে হয় তার দুর্ভোগ কেন বিচারপ্রার্থীদের পোহাতে হবে? তাছাড়া পুনঃশুনানিতে তো একই রায় নাও হতে পারে। এটাকে আমি বিচার বিভাগের একটি অরাজকতা হিসেবে দেখি।’

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মহসিন রশিদ বলেন, ‘আমার মনে হয় প্রধান বিচারপতি মামলাগুলো পুনঃশুনানিতে দিয়ে সঠিক কাজটিই করেছেন। কারণ, অবসরের পরে রায় লেখার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি বিচারপতি মানিক তাড়াহুড়ো করে যে রায় লিখেছেন তাতে ভুল হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিষয়টি হয়তো বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা মানছেন না। সে কারণে প্রধান বিচারপতি পুনঃশুনানিতে পাঠিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে বিতর্ক এড়ানোর পাশাপাশি মামলাগুলোর রায় আইনগতভাবে বৈধতা পাবে।’

পুনঃশুনানির কারণে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি তো হচ্ছেই। কিন্তু এই ১৬৮টি মামলার ক্ষেত্রে যে হয়রানি হলো, এটার দায়ভার দুই বিচারপতি ও আমাদের সিস্টেমের ওপর পড়বে।’



মন্তব্য চালু নেই