পিনাক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন আড়াই মাসেও প্রকাশ হয়নি

পদ্মার মাওয়ায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল  পিনাক-৬ ডুবির দীর্ঘ আড়াই মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি চার দফা সময় বাড়িয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর নৌ পরিবহণমন্ত্রী ও নৌসচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিলেও এর ৩৫ দিন পরও সে প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়।

অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত কমিটি গঠন এবং এর প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। এমনকি শিগগির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে নৌমন্ত্রী একাধিকবার সাংবাদিকদের বললেও প্রতিবেদন নিয়ে মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর গোপনীয়তা রক্ষা করছে।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, গত ২০ বছরে (১৯৯৪-২০১৩) ছোট-বড় মিলিয়ে ছয় শতাধিক দুর্ঘটনায় গঠিত কমিটিগুলোর অধিকাংশের মতো পিনাক-৬ এর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখবে না।

ওইসব দুর্ঘটনায় পাঁচ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটলেও মাত্র তিন-চারটি কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি নিকট অতীতে চলতি বছরের ১৫ মে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ এবং ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রামদাবাদ নদীতে এমভি শাথীল-১ দুর্ঘটনায় প্রায় ১০০ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটলেও ওই দুটি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।

গত ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা পিনাক-৬ লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলাধীন মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় ডুবে যায়। দুর্ঘটনার পর ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হলেও ১২ আগস্ট ৬১ জনকে নিখোঁজ দেখিয়ে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন।

পরবর্তী সময় আরো একজনের লাশ পাওয়া গেলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ এবং নিখোঁজের সংখ্যা কমে হয় ৬০। তবে শোকাহত স্বজনদের দাবি, নিখোঁজের সংখ্যা শতাধিক। এ ছাড়া ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন।

বহুল আলোচিত এই দুর্ঘটনার পর ওই দিনই অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও), ১৯৭৬ এর ক্ষমতা বলে সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের পরীক্ষক ড. এ এস এম নাজমুল হকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

একই দিন আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নুর-উর-রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে এম জসিমউদ্দীন সরকার (সদস্য সচিব), অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নজরুল ইসলাম সরকার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক নৌ-স্থপতি ড. গৌতম কুমার সাহা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সদস্য (প্রকৌশল) নৌ-স্থপতি ফিরোজ আহমেদ এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রহিম তালুকদার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ড. নাজমুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত কার্যক্রম চলা অবস্থায় নৌ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই কমিটি বিলুপ্ত করেন। আর যুগ্ম-সচিব নুর-উর-রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটি নির্ধারিত সময়ের পর চার দফা সময় বাড়িয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়।

তবে, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সাত সদস্যের কমিটিতে অপ্রয়োজনীয় দুজন নৌ-স্থপতি রাখা হলেও নৌ-প্রকৌশলী (মেরিন ইঞ্জিনিয়ার) রাখা হয়নি একজনও। এ ধরনের কমিটিতে যন্ত্র প্রকৌশলীর (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার) না থাকা সত্ত্বেও বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রহিম তালুকদারকে রাখা হয়েছে। তেমনি সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর থেকে রাখা হয়েছে দুজনকে।

এ প্রসঙ্গে জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার প্রাক্তন মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘পিনাক-৬ দুর্ঘটনার সঠিক কারণ চি‎হ্নিত করতে হলে ওই দিন নৌযানটি কারিগরিভাবে ত্রুটিমুক্ত ছিল কিনা তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একজন নৌ প্রকৌশলীর মতামত এবং পদ্মার গতিপ্রকৃতি কেমন ছিল তা জানতে একজন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞের মতামত অপরিহার্য ছিল। এ ছাড়া মালিক ও যাত্রীদের প্রতিনিধি থাকাও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু নৌ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিতে তেমন কেউ ছিলেন না। এসব কারণে ওই তদন্ত কমিটি এবং প্রতিবেদন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে এবং মন্ত্রণালয়ও প্রতিবেদন প্রকাশে গড়িমসি করছে।’



মন্তব্য চালু নেই