ফিরে দেখাঃ আগস্ট ২০১৪
পা যেখানে শাড়ির আঁচলে : এবার ফার্মগেটের যৌন ফাঁদ
[২০১৪ সালের আগস্ট মাসের একটি আলোচিত সংবাদ যা ফেসবুকে তুমুল আলোচলা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। ফিরে দেখাঃ অতীতের আলোচিত সংবাদ বিভাগে আমরা বাংলামেইলে প্রকাশিত এই সংবাদটি তুলে ধরলাম ছবি প্রতীকী]
রাজধানী শহর ঢাকা। হাজারো মানুষ হাজারো রকমের উদ্দেশ্য নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এ শহরের রাস্তাঘাট। সাধারণ মানুষকে নানা ফাঁদে ফেলে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতেও সক্রিয় বেশ কয়েকটি চক্র। এদের দৌরাত্ম্যে রাজধানী ঢাকা দিনদিন হয়ে উঠছে ফাঁদের নগরী। কোথাও রয়েছে পকেটমারের ফাঁদ, কোথাও আবার প্রতারক চক্রের।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর একটি ফাঁদ হলো- যৌনকর্মীদের শাড়ির আঁচলের আড়ালে পেতে রাখা ফাঁদটি। যেখানে একবার পা আটকালে দিয়ে আসতে হবে পকেটে থাকা সব টাকা পয়সা। সেই সঙ্গে সম্মানের টানা হেচঁড়া তো আছেই।
বুধবার রাত ১১টা। রাজধানীর পথগুলো প্রায় পথচারীশূন্য। মাঝে মধ্যে দু’একটি বাস ক্ষিপ্র গতিতে রাতের নীরবতা ভেঙে ছুটে চলেছে। এমন সময় মৃদু গতিতে যাত্রীসহ একটি রিকশা এসে থামলো ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে। শাড়ির ওপর বোরকা পরা চল্লিশোর্ধ এক নারী বসে আছেন রিকশাটিতে।
মুহূর্তেই মৌমাছির মতো রিকশার চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল কয়েকজন যুবক। এর ঠিক সামনে অর্থাৎ মৎস্য ফোয়ারার পাশে পুরনো একটি লেগুনায় ঘাপটি মেরে বসেছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বছিরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ। এসব ঘটনা খুব একটা আমলে নিচ্ছিলেন না তারা।
কিন্তু যুবকেরা ওই নারীর আরও খানিকটা কাছে আসতেই দৃশ্যপটে আসে দ্রুত পরিবর্তন। এতক্ষণ হেডলাইট জ্বালিয়ে যে লেগুনাটিতে পুলিশেরা বসেছিল হঠাৎ নিভে যায় তার আলো। দ্রুত এগিয়ে আসে ওই রিকশাটির দিকে। ঝটপট নেমে ফটাফট ওই যুবকদের লেগুনায় তুলে নেন পুলিশ সদস্যরা। দেরি না করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তারা। তবে সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে দিব্যি ঘুরতে থাকেন ওই নারী।
কিন্তু কে এই নারী? এতরাতে তিনি এখানে কেন? তার রিকশা থামতেই ওই যুবকেরা কেনই বা তাকে ঘিরে ধরলো? পুলিশই বা কেন ওই যুবকদের ধরে নিয়ে গেল? আবার তাকেই বা না নিয়ে রেখে গেল কেন?
রহস্যের জাল ভেদ করতে ওই নারীর কাছে গিয়ে আলাপের চেষ্টা শুরু করতেই সরাসরি তিনি প্রশ্ন করে বসেন, ‘সিঙ্গেল নাকি ডাবল? সিঙ্গেল হলে হোটেল ভাড়া বাদে ৫শ। আর ডাবল হলে এক হাজার।’
ঝুঁকি আছে কি না জানতে চাইলে মুচকি হাসি দিয়ে মধ্যবয়সী ওই নারী বলেন, ‘যা কইতাছি তাই শুনেন। না হলে বিপদে পড়বেন। পোশাক-আশাক দেইখাতো ভদ্র লোকের পোলাই মনে হয়। পুলিশের পিডান না খাইতে চাইলে যা কইতাছি হেইডা শুনেন।’
পরে ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতের বেশ কয়েক জন হকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত হলেই এখানে আনাগোনা বেড়ে যায় বোরকা পরা নারীদের। রিকশা, সিএনজি এমনকি প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। খদ্দের পেলে গাড়িতে তুলে মিটমাটের আলোচনা শুরু হয়। শেষ হয় পুলিশের হস্তক্ষেপে।
অর্থাৎ যৌনকর্মীরা দাঁড়ান আনন্দ সিনেমা হলের সামনে, পুলিশ বক্সটার পাশে। আর পুলিশ ঘাপটি মেরে থাকে মৎস্য ফোয়ারার আড়ালে। কখনো লেগুনায় আবার কখনো বিকল্প কোনো যানে। যৌনকর্মীদের গাড়িতে যেই কোনো একজন বসেন, ওমনি পুলিশ গিয়ে উপস্থিত হয় সেখানে। এরপর নাটকীয়ভাবে তাকে গাড়িতে তুলে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আবার আগের স্থানে ফিরে আসেন। এবং আবারও ঠিক আগের মতোই ঘাপটি মেরে থাকেন।
এসব গল্প শুনতে শুনতেই দেখা গেল সেই লেগুনাটি আবার আগের জায়গাতেই এসে থেমেছে। এবার লেগুনাটির কাছে গিয়ে এএসআই বছিরের কাছে কিছুক্ষণ আগে ধরে নিয়ে যাওয়াদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আরে ভাই, ওরা বাচ্চা ছেলেপেলে। ভুলে এখানে এসে পতিতাদের খপ্পরে পড়ছিল। তাই ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে অভিভাবকদের ফোন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।’
পুলিশের এমন বক্তব্যে রহস্যের গন্ধ আরও তীব্র হলো। তাই অবস্থান বদলে এবার দাঁড়ানো হলো একটু আড়ালে। বোরকা পরা ওই নারীর পাশে তখন বাহারী রঙের বোরকা পরা আরও অন্তত ৫ থেকে ৭ জন নারী এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছু যুবককে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। তবে কী কথপোকথন হচ্ছে তাদের মধ্যে তা শোনা যাচ্ছে না। এরপর সেই পুরনো দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি। আবারও ছুটে এলো লেগুনাটি। দ্রুত বেশ কয়েকজন কনস্টেবল নেমে ঝটপট তাদের ধরে ফেললেন। লেগুনাতে তুলে নিয়ে আবার চলে গেলেন কোথাও।
লেগুনার পিছু নিয়ে দেখা গেল সেটি ফার্মগেট ওয়াসা মাঠ অর্থাৎ লেগুনা স্ট্যান্ডের বিপরীত দিকে গিয়ে থামলো। একে একে যুবকদের লেগুনা থেকে নামিয়ে প্রত্যেকের পকেট চেক করে ছেড়ে দেয়া হলো। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে এএসআই বছির এবার বললেন, ‘ওরা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে এবং বলেছে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করবে না, তাই ছেড়ে দিলাম।’
কিন্তু পকেট থেকে কী নিলেন জানতে চাইলে বেশ বিব্রত হয়ে বছির বলেন, ‘রাতে ডিউটি করলে থানা থেকে কোনো তেল বা গ্যাসের খরচ দেয়া হয় না। তাই লেগুনার গ্যাস নেয়ার জন্য ওদের পকেট চেক করলাম। ৫৮ টাকা পেয়েছি এই দেখেন।’
রাতে সিনেমা হলের আশপাশে অবস্থান নেয়া নারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা প্রতিদিনই এখানে আসেন। ঘোরাফেরা করেন। এছাড়া কিছু না।’ তো যুবকদের ধরলেন কিন্তু নারীদের ধরলেন না- এর কারণ জানতে চাইলে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বছির বললেন, ‘আরে ভাই, মহিলাদের কী বলবো? তাদের কিছু কইলেই তো আবার কইবেন পুলিশ নারী নির্যাতন করে!’
মন্তব্য চালু নেই