পাঁচ বছরে সাড়ে ৬ হাজার বেওয়ারিশ লাশ ঢাকায় দাফন

গত পাঁচ বছরে ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত ৬ হাজার ৪ শত ৭৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। যা বছরে গড়ে হয় ১২৯৫টি লাশ। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম আট মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৮ শত ৯টি লাশ। যা প্রতি মাসে গড়ে ১০১টি এবং প্রতিদিন গড়ে চারটি মৃতদেহ নাম-পরিচয় অজ্ঞাত রেখেই সমাহিত করা হচ্ছে। এসব তথ্য জানিয়েছে বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী বেসরকারি সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, ২০১০ সালে তারা ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে ১২০৪ টি। ২০১১ সালে লাশ দাফন করেছে ১১৯১ টি, ২০১২ সালে ১২৪৭ টি, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের লাশ বাদেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৩০ টি, ২০১৪ সালে ১৪০৫ টি।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সুত্রে জানা গেছে, পুলিশের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব লাশের অধিকাংশই হত্যাকাণ্ডের শিকার। বেশিরভাগ সময় লাশগুলোয় মারাত্মকভাবে জখমের চিহ্ন দেখা যায়, চেহারাসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করে ফেলা হয়। অনেক সময় হত্যা করার পর লাশগুলোকে গাড়ি দিয়ে চাপা দেয়া হয়। আবার কখনো মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন এলাকায় ফেলে রাখা হয়। এমনই বিভিন্ন রকমের কৌশল অবলম্বন করে হত্যাকারীরা। পুলিশের কাছে ডিএনএ টেস্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহে প্রযুক্তিগত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তদন্তে বেশিদূর এগুতে পারেন না তারা। নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় হত্যার কোনো ক্লু বের করতে পারে না পুলিশ। ফলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অপরাধীরা। পরবর্তীতে লাশগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আ্ঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে।

আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিস) মোঃ আব্দুল হালিম বলেন, ‘বেওয়ারিশ লাশগুলো আমাদের কাছে সাধারণত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে ময়না তদন্তের রিপোর্ট তৈরি করার পর পুলিশ তদন্ত করে। লাশের পরিচয় সন্ধান না পেলে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে। লাশগুলোকে আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। আমরা লাশ উদ্ধারের তারিখ, স্থান ও সংশ্লিষ্ট থানার নাম নথিভুক্ত করে রাখি।’

তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বেওয়ারিশ কোনো লাশ পরে আর শনাক্ত করা সম্ভব হতে দেখেননি বলে জানান হালিম।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো জায়গায় নাম-পরিচয় হীন লাশ পাওয়া গেলে লোকজন লোকাল থানায় জানায় এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। ময়না তদন্ত শেষে লাশ কিছুদিন সংরক্ষণ করা হয় এবং ছবি তুলে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট থানায় লাশের ছবি, পোশাক ও তথ্য-উপাত্ত ডাটাবেজ করে রাখা হয় এবং আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করে এবং লাশের ছবি, পোশাক ও তথ্য-উপাত্ত সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।’

লাশ কতদিন সংরক্ষণ করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি লাশের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। লাশটি যদি বেশি বীভৎস অর্থাৎ পচে-গলে যায় তাহলে চাইলেও বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। আর অন্যথায় যতদিন সম্ভব আমরা লাশ সংরক্ষণ করে থাকি। তাছাড়া লাশ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার সংকটও আছে।

তিনি আরও বলেন, লাশগুলো হত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা নাকি অপমৃত্যু এসব দিকগুলো খতিয়ে দেখে পুলিশ। কেউ হারিয়ে গেলে থানায় দায়ের করা জিডিগুলো মিলিয়ে লাশ শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে একান্তই নাম-পরিচয় বের করতে না পারলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম কাছে দেয়া হয়। এছাড়া এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতেও লাশ দাফন করা হয়।

পরবর্তীতে কী পরিমাণ লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ সংক্রান্ত কোনো ডাটা আমাদের কাছে নেই।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, `আমাদের দেশে গোটা ব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। উন্নত বিশ্বে একটি তথ্য থেকে আরও দশটি তথ্য বের করা সম্ভব হয়। লাশের থেকে উদ্ধার হওয়া সিম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ও স্মার্ট কার্ড থেকে পরিচয় খুঁজে বের করা যায়। আমাদের দেশে এরকম সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। যে কারণে এখন আবার নতুন করে সিম কার্ড নতুন করে রেজিস্ট্রেশনের কথা হচ্ছে।`

তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেওয়ারিশ লাশগুলো গরিব মানুষের। উন্নত দেশগুলোতে এরকম লাশ উদ্ধার হলে লাশের পরিচয় শনাক্তকরণসহ তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশে লাশগুলো গরিব মানুষের হওয়ায় পুলিশের খুব একটা তৎপরতা দেখা যায় না। আমাদের মাইন্ডসেট ও সামাজিক মূল্যবোধের সংকীর্ণতা রয়েছে।’

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, এজন্য পুলিশকে এককভাবে দায়ী করে লাভ নেই। কারণ বিষয়গুলোকে যথাযথ তদন্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও প্রযুক্তি পুলিশের কাছে নেই।

প্রসঙ্গত, ২০০২ সালের ১১ই নভেম্বর বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এক নারীর লাশ। বেওয়ারিশ হিসেবেই তা জুরাইন কবরস্থানে দাফন করে দেয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। পরে সেটি মডেল কন্যা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির বলে শনাক্ত হয়।



মন্তব্য চালু নেই