পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা মেয়েরা শেষ পর্যন্ত কোথায় হারিয়ে যায়?

সোহরাব হাসান : শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নুরুল ইসলাম নাহিদের সাফল্য হলো সময়মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণ এবং সময়মতো ফল প্রকাশ। আগে একেক বছর একেক সময় এসব পরীক্ষা হতো এবং যথেষ্ট বিলম্বে ফল প্রকাশ পেত। শিক্ষামন্ত্রী সেটি একটি নিয়মের মধ্যে এনেছেন। এর ফলে উচ্চতর শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রমেও মোটামুটি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। আগে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বছর খানেক বসে থাকতে হতো। এখন চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই উচ্চতর শ্রেণিতে ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। প্রক্রিয়াটি আরও এগিয়ে আনা উচিত।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে দেখা যায়, পাসের হার ও জিপিএ-৫ বেড়েছে। তবে পাসের সঙ্গে শিক্ষার মান বেড়েছে, সে কথা বলা যাবে না। এবারে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। পরীক্ষার্থী ছিল ১২ লাখ ৩ হাজার ৫৪০। এর মধ্যে পাস করেছেন ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০।
এবারেও এইচএসসি পরীক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করেছেন। অনেক দিন ধরেই এসএসসি ও এইচএসসিতে তাঁদের এই অগ্রযাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। বৃহস্পতিবার গণভবনে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মেয়েরা এইচএসসিতে ভালো করেছে, এ জন্য খুশি। ছেলেমেয়ে সবাইকে অভিনন্দন। সন্তান সন্তানই। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, সবাইকে শিক্ষিত করতে হবে।’
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অনেক বিদ্যালয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়ের সংখ্যাও বেশি। পরীক্ষায়ও তাঁরা ভালো করেছেন। আমরাও তাঁদের অভিনন্দন জানাই।
এই যে প্রতিবছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমানে সমান লড়ে যাচ্ছেন, সেটি যেমন আমাদের আশা জাগায়, তেমনি পরবর্তীকালে এর ধারাবাহিকতা দেখতে না পেয়ে হতাশ হতে হয়। স্নাতক পর্যায়ে এসেই আমরা বড় ধরনের ধাক্কা খাই।
২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৬৮ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ১ হাজার ৩১৮ এবং ছাত্রী ৭ লাখ ৭২ হাজার ৬৫০ জন। বেসরকারি ৭৮টি বিদ্যালয়ে মোট ৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী মাত্র ৮৬ হাজার ৬৪৫। সরকারি ও বেসরকারি মিলে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত যথাক্রমে ৬০ ও ৪০। অথচ এইচএসসিতে প্রায় সমানে সমান। হঠাৎ করে ব্যবধানটি বাড়ার পেছনের কারণ কী? কারণ, মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য যে অভয় পরিবেশ, যে আর্থিক সচ্ছলতা থাকা প্রয়োজন, তা আমরা দিতে পারিনি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। এরপর সে ধরনের প্রণোদনা নেই। পড়াশোনা করার পর কর্মসংস্থানেরও নিশ্চয়তা নেই। নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক মা-বাবা আগেভাগে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান। সমাজে এখনো কন্যাসন্তানকে দায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকেই ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বৈষম্যটি বাড়তে থাকে। চাকরির ক্ষেত্রে সেটি আরও প্রকট। বাংলাদেশে মেয়েরা এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি করলেও প্রায় সব খানে তাঁদের উপস্থিতি কম। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত মানসুরা হোসাইনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার না বেড়ে কমেছে। ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ। ২০১৩ সালে সেটি কমে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এই জরিপ অনুযায়ী পুরুষ জনগোষ্ঠীর ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও নারীদের বেলায় এই হার ৩৩ শতাংশ। অর্ধেকের কম।
কেন এমনটি হচ্ছে? অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, আর্থসামাজিক কারণেই মেয়েদের কর্মসংস্থানের হার কমছে। প্রথমত, আমরা যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা দিতে পারছি না। আবার যে শিক্ষা দিচ্ছি, উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় মেয়েরা সেটুকুও কাজে লাগাতে পারছেন না। অনেক সময় মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে নানা রকম হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হন। আইনি সুরক্ষাও তাঁরা পান না। ঘরে–বাইরে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই তাঁদের অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায়। যোগ্যতা বিচার না করেই বলা হয়, এ কাজ মেয়েরা পারবে না। একটি উদাহরণ দিই। বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার আগে গণমাধ্যমে মেয়ে রিপোর্টার ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন।
নীতিনির্ধারকেরা মনে করতেন, মেয়েরা রিপোর্টিং করতে পারবেন না। কিন্তু এখন প্রমাণিত যে উপযুক্ত পরিবেশ ও সমর্থন পেলে তাঁরাও পারেন। আবার অনেককে পারিবারিকভাবেও চাকরি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বলা হয়, টাকাপয়সার যেহেতু সমস্যা নেই, সেহেতু চাকরি করার দরকার কী? ছেলেদের বেলায় কিন্তু এ অজুহাত কেউ তোলেন না।
এ কারণেই উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরেও অনেক মেধাবী মেয়ে হারিয়ে যান। নিজের মেধা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন না। এটি যে কেবল সাধারণ শিক্ষার বেলায় ঘটে তা–ই নয়, চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যার মতো বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়েও অনেক মেয়ে তা কাজে লাগাতে পারেন না বা লাগাতে দেওয়া হয় না। নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সবখানে মেয়েদের সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য চালু নেই