নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে

আগামী ২৮ এপ্রিল, ২০১৫ ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আসন্ন সিটি নির্বাচনে প্রশাসন যদি নিরপেক্ষতা দেখাতে না পারে তাহলে সে নির্বাচন ‘৫ জানুয়ারি’র জাতীয় নির্বাচনের মতো বিতর্কিত হবে, একদলীয় নির্বাচন হবে তাতে সন্দেহ নেই। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে তাতে বলা যায় এ নির্বাচনটিও সরকারি দলের নগ্ন হস্তক্ষেপের বাইরে নয়। কিন্তু তামাশার নির্বাচন দিলে সরকারি দলের কর্তাব্যক্তি ও নেতাকর্মী ছাড়া অন্যরা উপকৃত হবেন-তা আশা করা যায়না। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র ও কাউন্সিলর পদ প্রার্থীরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পুলিশের বাড়াবাড়ির কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সে অভিযোগকে নাকচ করে দিচ্ছেন।

নির্বাচন কমিশন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজগুলো সুষ্ঠু হচ্ছেনা। আইনত স্বাধীন হলেও কার্যত নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। যে কারণে সিইসি যা বলছেন তা প্রয়োগ করতে পারছেন না। তিনি যদি খুব বেশি স্বচ্ছতা দেখাতে চান তাহলে হয়তো আবারও বিদেশ ভ্রমণের টিকেট পেতে পারেন। যে ভাবে তিনি গত উপজেলা নির্বাচনের এক পর্যায়ে ছুটিতে ছিলেন। এবারও ঠিক সে রকম নির্বাসনে যাবেন কিনা বা যেতে বাধ্য করা হবে কি-না তা বলা যায়না। কিন্তু এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে, দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ আসবে কি করে ? দীর্ঘদিন অবরোধ-হরতালে সাধারণ মানুষ বলছেন, আমরা প্রায় মৃত।

দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল, দোকানপাট খুলতে পারেননি, গাড়ী চলেনি, প্রতিনিয়ত লোকসান গুণতে হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো এসব চায়না, সকলেই শান্তিতে বাস করতে চায়। ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। দলীয় অর্থে নয়-প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়। কিন্তু যারা সরকারে আছেন তারা বলছেন, আমাদের চেয়ে কেউ বেশি গণতান্ত্রিক নয়, আমরাই সফল, আমরাই ক্ষমতায় থাকার যোগ্য, আগের সব সরকারের আমলের চাইতে দেশ ভাল চলছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। মূলত তারা সাধারণ মানুষের বেদনা বুঝেও না বুঝার ভান করছেন।

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

যখন যে দল সরকারে থাকুক না কেন তাকে সমর্থন না করা কি অপরাধ ! দেশে কি অন্য কোনো দল বা ভিন্ন মত থাকতে পারেনা ! সেটা যদি নাই থাকবে তাহলে গণতন্ত্র কায়েম হবে কীভাবে ? শুধু কাগজ-কলমে আর মুখে মুখে গণতন্ত্র থাকলে-তো হবেনা। গণতন্ত্রের নামে দেখছি-এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা, নামমাত্র ও নিয়ন্ত্রিত সংসদ, একচেটিয়া ক্ষমতার প্রভাব, এক রাষ্ট্র এক নেতার প্রভাব আর মিথ্যাচার যেন আজ ব্যস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কিছুই যেন সরকারি নিয়ন্ত্রণে। সেই সাথে বিরোধীদের দমন ও কন্ঠরোধের যত পর্যায় আছে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পাবলিক টয়লেট পর্যন্ত সবখানেই সরকারদলীয় লোকদের হস্তক্ষেপ।

সেই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন, দুদককেও দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের দিকে না গিয়ে ক্রমশ বাঁকা ও বিতর্কীত পথে হাটছেন তারা। বিরোধীদল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে সে জন্য যত ব্যবস্থা আছে তার সবই করা হচ্ছে। আর নির্বাচনে এলেও যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে না পারেন তার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরকম একটি দেশকে গণতান্ত্রিক বলার কী যুক্তি থাকতে পারে। মনে রাখা দরকার, এ ধরণের নেতিবাচক মানসিকতা লালন করা একটি জাতির জন্য অকল্যাণকর।

সিটি নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে ‘সমতল খেলার মাঠ’ কথাটি প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। মাঠে প্রতিটি খেলোয়াড় সমান সুযোগ পাবে, কারো প্রতি যুলুম করা বা অন্যায় করা হবেনা-এটাই নিয়ম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনী ক্ষেত্রে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী জোটের কাউন্সিলর ও মেয়র প্রার্থীরা। কিন্তু তাদের এ অভিযোগ তেমন গুরুত্বের সাথে আমলে নিচ্ছেনা নির্বাচন কমিশন। তারা সরকারের দেয়া সেই পুরনো রেকর্ডগুলোই বাজিয়ে শোনাচ্ছে বলে সিইসির ডাকা বৈঠক থেকে উঠে গেছেন বেশ কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী।

অভিযোগ উঠেছে, ২০ দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছেন না। নানভাবে তাদেরকে বাধা দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের বিরুদ্ধে মামলার জট। কেউ নিজ নামে আসামী, কেউ বেনামে সন্দেহভাজন আসামী বা অজ্ঞাতনামার আসামী। অনেক আসামী এমন আছেন যে, তারা জানেন-ই-না তাকে কেন আসামী করা হচ্ছে। সরকারিদলের প্রার্থীরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মহড়া দিতে পারলেও এলাকায় ফিরতে পারছেনা ২০ দলীয়জোটের অধিকাংশ প্রার্থী।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া যদি প্রচারণা চালাতে মাঠে নামতে পারেন আর সরকারের মন্ত্রীরা যদি নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে না পারেন তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো কিভাবে ? মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জিজ্ঞাসা, আপনার এ যুক্তিটি যদি যথার্থ হয়ে থাকে আর নির্বাচনকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা না হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকতে আপনারা পদত্যাগ না করে নির্বাচনে প্রার্থী হলে সেখানে কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় থাকে ? নিশ্চয়ই নয়।

তবে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সেনা মোতায়েন করা দরকার বলে অনেক প্রার্থীই দাবি করেছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে আগ্রহী নয়। আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত অনেকবাহিনী থাকলেও সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা একটু বেশী বলেই যে কোন নির্বাচন বা যে কোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনামোতায়েনের দাবি করা হয়। কথা হলো, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে এত অনীহা কেন? অপরদিকে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন বলেছেন, ‘সেনা মোতায়েনের দাবী অযৌক্তিক।’ সেনা মোতায়েন করা হলে রাষ্ট্রের এমন কি ক্ষতি হবে যে এটা নিয়েও নয়-ছয় বলা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯৩ ওয়ার্ডে ২০ দলীয় জোট সমর্থীত ৫৪ কাউন্সিলর প্রার্থীরা বিভিন্ন মামলার আসামি। প্রার্থীদের দাবি মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং হয়রানির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। আদালতে জামিনের আবেদন করেও তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। এসব প্রার্থীদের পক্ষে নিজ নিজ নির্বাচনকার্য পরিচালনা ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের বায়েজীদ এলাকায় মেয়র প্রার্থী মনজুর আলমের নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। না, পারেনি। কোন ভাবেই এসব বেআইনি কাজ করতে দেয়া যাবেনা। অথচ প্রার্থীরা যথাযথ অভিযোগ করলেও অস্বীকার করছেন সিইসি।

তাছাড়া, ‘জেলে থেকেও নির্বাচন করা যায়’- এ ধরণের উক্তি করে কি বোঝাতে চান তা জনগণ বুঝে। এ ভাবে কথা বললে সেই নির্বাচন কমিশন কীভাবে ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও জাল ভোট বন্ধ করবেন- এ প্রশ্ন থেকেই যায়। মতবিনিময় সভায় অনেক প্রার্থীই ভোটবাক্স, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের আশঙ্কার কথা বললে সিইসি আশ্বস্ত করে বলেছেন, এবার আর তা হবেনা। যদি হয় অনিয়ম হয় তাহলে তিনি তা স্বীকার করে নিবেন বলে মনে হয়না।

বিগত উপজেলা নির্বাচনই যার নিকটতম উদাহরণ। বারবার বলা হচ্ছে, আইনের ব্যতয় ঘটলে কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। তাহলে কেন ছাড় দিচ্ছেন এ প্রশ্ন আসতেই পারে। মূল কথাটি কী, অভিযুক্তদেরকে ছাড় দিচ্ছেন নাকি ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ পর্যন্ত দেখেছি, আচরণবিধি লংঘন করার অসংখ্য অভিযোগের ফলে কেবল ভর্ৎসনা, সতর্ক ও জরিমানা করেই সিইসি তার দায় এড়িয়েছেন। তাই এরকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচন কীভাবে সরকারদলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা যায় সে চেষ্টা করা উচিত।

একজন মেয়র প্রার্থী বলেছেন, পৃথিবীর কোন শক্তি নাই পরাজিত করবে। তিনি এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে। নির্বাচনী ফলাফল কি ভোটের আগেই তৈরী করা হয়েছে ! তার একথাটি দু’দশক আগের একটি ভাষণকে মনে করিয়ে দিল। ঢাকার জনৈক এমপি প্রার্থী একবার তার নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আমি ভোট পাবো শতকরা ৫৫%, আর সুষ্ঠু নির্বাচনের বিপরীত কোন পরিস্থিতি হলে ভোট পাবো শতকরা ৮০%। উপরের এ বক্তব্যকে সাধারণ মানুষ ভালভাবে দেখছেন না। পৃথিবীর কোন শক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারবেন না এ বক্তব্যের মূলে কোন শক্তি আছে তা নির্বাচন কমিশনকে খতিয়ে দেখা উচিত। যে মেয়র প্রার্থী নিজেই আইন মানছেন না সে নির্বাচিত হলে কীভাবে তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন।

‘প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে অসহায় ইসি’ এমন সংবাদ এখন প্রায় পত্রিকার পাতাজুড়ে। আসন্ন সিটি নির্বাচনী ফলাফল যদি সরকারের নির্দেশে হয় তাহলে জনগণের প্রত্যাশা ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতির মাঝ আকাশ-পাতাল ব্যবধান থেকেই যাবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। আর এটা তারা নিজেরাই অর্জন করেছেন ‘৫ জানুয়ারি’র সংসদ নির্বাচন ও এর পরের উপজেলা নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকা রেখে।

তারা নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে ৪০-৪২ ভাগ ভোটার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে । কিন্তু অপর কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যই সেই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ১০ ভাগের বেশি বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ কথাগুলো এজন্য বলছি যে, যাতে করে সিটি নির্বাচন সেই জাতীয় নির্বাচনের মতো না হয়। সে জন্য সরকারকে স্বার্থপরতা পরিহার করে আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে কোন প্রার্থী যেন সরকারকে খুঁটি বানাতে না পারেন সে বিষয়ে সরকারের সহযোগীতা কামনা করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই