নারী নির্যাতন মামলার ‘অধিকাংশই মিথ্যা’!

দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অথচ এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এগুলোর ‘অধিকাংশই মিথ্যা মামলা’। এর ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ। এসব মামলা তাই আপসে নিষ্পত্তির জন্য আদালত থেকে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের কাছে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন বিচারকেরা।

এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে, আমি আশা করি বিচারেকরা যেসব ক্ষেত্রে অনুধাবন করবেন যে মামলা মিথ্যা, সেসব ক্ষেত্রে তাঁরা আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।’

জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, বিচারকদের এই মূল্যায়ন সঠিক। তবে কেন এটা ঘটছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে ২০০০ সালের ওই আইনে উপযুক্ত সংশোধনী আনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। নির্যাতিত নারীর সামনে প্রতিকারের অন্য বিকল্প বন্ধ থাকায় তাঁরা সমস্যায় পড়লে পুলিশ, আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের পরামর্শে এ ধরনের মামলা করেন বলে মনে করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টে ২৫ ডিসেম্বর জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের ঘরোয়া কর্ম-অধিবেশনে আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. ইমান আলীর সভাপতিত্বে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার ৪০টির বেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা এক উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। এ বিষয়ে প্রস্তুত করা ১০ দফা-সংবলিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে ‘মিথ্যা মামলা’কেই ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১০ দফা সুপারিশের মধ্যে ধর্ষণের ভিকটিমকে নারী ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করতে আইনে বিধান আনা, পরীক্ষা করাতে রাজি হতে ভিকটিমদের সচেতন করা, পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে দাখিলের সময়সীমা মানতে পুলিশকে বাধ্য করা, শিশুর বয়স কোনো আইনে ১৮ কোনো আইনে ১৬ বছর থাকার মধ্যে সমতা আনা, ডাক্তারি পরীক্ষার সনদ যথাসময়ে পাওয়া এবং ডাক্তার সাক্ষীদের তলব করার বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট বিধান করার তাগিদ রয়েছে।

তবে বিচারকেরা অন্য যেসব সুপারিশ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ছেলেশিশুদের যৌন হয়রানির শাস্তি আইনে যুক্ত করা, মিথ্যা মামলার জন্য জরিমানার বিধান করা, শাস্তি প্রদানে সমতা আনতে বিধি করা, আইনের ১৯ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা রহিত করা হলেও ম্যাজিস্ট্রেটরা জামিন দিচ্ছেন বা দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। তাই এখানেও আইনের সংশোধনী আনা। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার যৌতুক-সংক্রান্ত মামলাগুলো আপসে নিষ্পত্তির জন্য জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে যেন পাঠানো হয়।

ওই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিচারকেরা একমত হন যে, বাস্তবে ওই আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটছে। আবার কঠোরতর শাস্তির বিধান ও তা কার্যকর করা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌতুকের মতো অপরাধের প্রকোপ কমেনি। এ জন্য তাঁরা বিদ্যমান আইনের কিছু ধারা অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে সংশোধন করার সুপারিশ করেছেন। তাঁরা আক্ষেপ করে বলেছেন, আইনের ১১ক ধারায় যৌতুকের জন্য শুধু মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান আছে। এর ফলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে সাজা দেওয়া যায় না, যা মানবাধিকার পরিপন্থী। আবার স্বামী-স্ত্রী বিরোধে জড়িয়ে প্রথমে মামলা করলেও পরে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বা অন্য কারণে তাঁরা সংসার টেকাতে আপস করতে চান। কিন্তু আইনে আপসের সুযোগ নেই। এ ছাড়া ১৬ বছর আগে ওই আইনে যুক্ত করা ৩৩ ধারায় সরকারকে একটি বিধি তৈরি করে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় বা মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় যথা পদক্ষেপ নেয়নি। বিধি না থাকার কারণে মামলা পরিচালনায় বিরাট সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আইনমন্ত্রী বিধি না থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তাঁর নিবন্ধে বলেন, এই আইনে দায়ের করা মামলার ৮০ শতাংশই যৌতুক-সংক্রান্ত। এর মধ্যে কেবল যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে সাধারণ জখম করা কিংবা গুরুতর জখম করা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো মামলার সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। তিনি বলেন, তাহলে প্রশ্ন আসে, বাকি মামলাগুলো কি মিথ্যা? এর জবাবে বলা যায়, শুধু যৌতুকের দাবিতে মারধর করে সাধারণ জখম হওয়ার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যৌতুকের জন্য মারপিট করার উপাদান অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তবে এই মামলাগুলো একেবারেই মিথ্যা নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে মতের অমিল হলে কিংবা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকার কারণে বনিবনা না হলে কিংবা স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে স্ত্রীর মতামতের পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবন অশান্তিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী কোনো উপায়ন্তর না দেখে এবং এ-সংক্রান্ত কোনো ফোরাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে দ্রুত প্রতিকার লাভের আশায় স্বামীকে এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের আসামি করে এই আইনের ১১(গ) ধারার বিধান অনুযায়ী মামলা দায়ের করে থাকেন।

উল্লেখ্য, বিচারকেরা তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, এসব মামলায় বাদী আইনজীবীদের পরামর্শে চিকিৎসকের কাছ থেকে সাধারণ জখমের সনদ নেন। আর সেই সনদসহ তিনি থানায় গিয়ে এ-সংক্রান্ত এজাহার করার জন্য অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে একটি অ্যাফিডেভিট স্থানীয় নোটারি পাবলিকের কার্যালয় হতে সংগ্রহ করে অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন।

ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রবণতা লক্ষ করেন তাঁরা। যৌতুক ছাড়া বাকি ২০ শতাংশ মামলার মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন উল্লেখযোগ্য।

ওই আইনের ৯(৪)(খ), অর্থাৎ ধর্ষণের চেষ্টা এবং ১০ ধারার যৌন পীড়ন ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রায়ই মামলা আমলে নেওয়ার পর এবং আসামি গ্রেপ্তার কিংবা তাঁর স্বেচ্ছায় হাজির হওয়ার পর জামিনের আবেদন-সংবলিত যে দরখাস্ত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়, তাতে বিচারকেরা দেখেন যে, বর্ণিত ধারাগুলোর অপরাধের উপাদান অনুপস্থিত। অথচ পক্ষদের মধ্যে টাকাপয়সার লেনদেন, জমিজমা-সংক্রান্ত জটিলতা অথবা সীমানা-সংক্রান্ত বিরোধের কারণে সেসব সমস্যা চিহ্নিত না করে দ্রুত নিষ্পত্তির আশায় কিংবা প্রতিপক্ষকে কারাগারে পাঠানো কিংবা হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এসব মামলা করা হয়।

ভিন্ন এক নিবন্ধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে ১৭ ধারায় অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে পুনরায় আরেকটি মামলা দায়ের করে মামলা সংখ্যা না বাড়িয়ে জরিমানার বিধান করা জরুরি বলে মত দেন।



মন্তব্য চালু নেই