নারী নির্যাতন আইনে শুধু মৃত্যুদণ্ড অসাংবিধানিক

নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জনৈক শুকুর আলীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে নারী ‍ও শিশু নির্যাতন আইনে শুধু মুত্যদণ্ডের বিধান থাকাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে।

মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ সংক্রান্ত কয়েকটি জেল আপিলের শুনানি শেষে এই রায় দেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন মোল্লা। তিনি জানান, রায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৬নং ধারার ২, ৩ ও ৪ উপধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়। কারণ আইনের এসব উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ধর্ষণ করে শিশু ও নারীর মৃত্যু ঘটান তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আদালত বলছে, এই ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প কোনো সাজা না থাকায় তা সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন জানান, বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) নারী নির্যাতন আইনের ৬নং ধারার ব্যাখ্যা চেয়ে একটি আবেদন দায়ের করে। পাশাপাশি বেশ কিছু জেল আপিল এই মামলার সঙ্গে অর্ন্তভুক্ত হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে আপিল বিভাগ এই রায় দিয়েছেন।

ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বিকল্প শাস্তির বিধান না রেখে প্রণীত ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের তিনটি ধারা এবং ওই আইন সংশোধনের পরও আগের মামলাগুলো পুরনো আইনে চালানোর বৈধতা দিয়ে ২০০০ সালের আইনে যুক্ত একটি ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে আপিল বিভাগ।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ এর ২, ৩, ৪ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে।

ওই ধারাগুলোতে ধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে সাজা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনটি ধারায় সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হলেও ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার দায়ে কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল।

২০০০ সালে আইনটি সংশোধন করা হলে পুরনো আইন রহিত হয়ে যায়। নতুন আইনের ৯(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

কিন্তু ২০০০ সালের আইনের ৩৪ এর ২ ধারায় বলা হয়, এ ধরনের অভিযোগে ১৯৯৫ সালের আইনে যেসব মামলা বিচারাধীন, সেগুলো ওই আইনেই চলবে।

আপিল বিভাগের রায়ে এই ধারাটিও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে।

মৃত্যুদন্ড ছাড়া বিকল্প শাস্তির বিধান না থাকায় এর আগে হাই কোর্ট ১৯৯৫ সালের আইনের ৬ এর ২ ধারা সংবিধানপরিপন্থী বলে রায় দিয়েছিল।

আইনজীবীরা বলছেন, ১৯৯৫ সালের আইনে বিচারাধীন মামলাগুলোর ভবিষ্যত এখন কী হবে তা আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর জানা যাবে।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার শিবরামপুর গ্রামে শুকুর আলী নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। ২০০১ সালের ১২ জুলাই বিচারিক আদালত শুকুর আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরের বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগেও সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে।

শুকুর আলী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ওই বছরের ৪ মে তাও খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।

এরপর শুকুর আলী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

২০১০ সালের ২ মার্চ হাই কোর্ট ৬ এর ২ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তবে আপিল বিভাগে শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় হাই কোর্ট তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।

সাজা না কমায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবারও আপিল বিভাগে আসেন শুকুর ও ব্লাস্ট। এছাড়া ওই আইনে দণ্ডপ্রাপ্তদের আরও ১০টি আবেদনের শুনানি করে গত মাসে আপিল বিভাগ বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।



মন্তব্য চালু নেই