দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড

নজরদারিতে ১৩ ‘বড় ভাই’

ইতালির নাগরিক সিজারে তাভেল্লা ও জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ‘বড় ভাইয়ের’ সংখ্যা অন্তত ১৩। তাঁদের মধ্যে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা চারজন, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা তিনজন। বাকি ছয়জন জামায়াতে ইসলামীর নেতা। এই ‘বড় ভাইদের’ মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ছিলেন তিনজন। ১৩ জনের মধ্যে চারজন ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ের নেতা। তাভেল্লা হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে ‘বড় ভাই’ হিসেবে ইতিমধ্যে বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের নাম সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। ১৩ জনের মধ্যে তিনিও আছেন; যদিও ইতিমধ্যে তিনি দেশ ছেড়েছেন। বাকিরা গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে আছেন। তাঁদের আটকের বিষয়ে সরকারের হাইকমান্ডের সংকেতের অপেক্ষায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেতও দেওয়া হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশের উচ্চপর্যায়ের সূত্র কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পরপরই বিমানে করে দেশ ছেড়েছেন কাইয়ুম। এখন কিভাবে তিনি দেশ ছেড়েছেন তার বিশ্লেষণ চলছে। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার পেছনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যের গাফিলতি ছিল কি না তা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ সদর দপ্তর। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করছে, কুনিও হত্যার ঘটনায় ‘বড় ভাই’ হিসেবে নেপথ্যে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। তিনি দেশেই আছেন। পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে এ বিষয়ে তথ্য আছে।

সূত্র জানায়, কাইয়ুম ও সোহেল বাদে নজরদারিতে থাকা অন্য ‘বড় ভাইদের’ মধ্যে আছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী সফু, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আজিজুল বারী হেলাল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, জামায়াত নেতা ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ, ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির মাওলানা রফিকুল ইসলাম, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বাকি চারজন রংপুরের বিএনপি ও জামায়াত নেতা।

ইতালির নাগরিক সিজারে তাভেল্লা ও জাপানের নাগরিক কুনিও হোশিতাভেল্লা হত্যায় জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও কুনিও হত্যার রহস্য এখনো উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁরা চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্ত অনেকখানি গুছিয়ে এনেছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের গ্রেপ্তারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।

বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা ‘বড় ভাই’ ও ‘ঘাতকদের’ বিষয়ে মন্ত্রীদের অবহিত করেছেন। সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নজরদারিতে থাকা বড় ভাইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে বলেও বৈঠকের একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই বিদেশি হত্যার ঘটনায় অনেক রাঘব বোয়ালের নাম আসছে। সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছেন। আমরা তাঁদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। রাঘব বোয়ালরা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন, পর্যাপ্ত তথ্য পেলেই তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে তাভেল্লা হত্যার কিলারদের ধরা হয়েছে। কুনিও হত্যার তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সব কিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যেই জাতিকে বিস্তারিত জানানো যাবে।’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় সিজারে তাভেল্লা এবং ৩ অক্টোবর রংপুরে কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের পর দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। পর পর ঘটে যাওয়া দুই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের ধরতে র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি বিদেশি সংস্থাগুলোও তদন্ত চালায়। পুলিশ দাবি করছে, ইতিমধ্যে তারা তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে। কুনিও হত্যার তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

র‌্যাব ও পুলিশ দাবি করছে, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতেই বিএনপি ও জামায়াতের ‘বড় ভাইদের’ নির্দেশে দুই বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। তাভেল্লা হত্যায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার চারজনও বড় ভাইদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।

দুই হত্যা মামলার তদন্তে জড়িত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক কারণে ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই দুই বিদেশিকে হত্যা করা হয়। এতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতে ইসলামীর একাধিক নেতার প্রত্যক্ষ সহায়তা ছিল। এর মধ্যে অন্তত ১৩ জনের নাম উদ্ঘাটন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিএনপি নেতা চারজন, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা তিনজন ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছয়জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ের চার নেতাও আছেন। ১৩ জনের মধ্যে তিনজন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ছিলেন।

11র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ১৩ জনকেই ‘বড় ভাই’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাঁদের মধ্যে একজন দেশের বাইরে চলে গেছেন। বাকিরা দেশেই আছেন এবং নজরদারির মধ্যেই রয়েছেন। তাঁদের মোবাইল ফোন নিয়মিত ট্র্যাকিং করা হচ্ছে; যদিও কয়েকজনের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে।

কয়েকটি পত্রিকায় খবর এসেছে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ইতিমধ্যে ভারত চলে গেছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো এ ধরনের কোনো তথ্যের সত্যতা পায়নি। সোহেলের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলেও অনুসারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাব ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘বড় ভাইয়েরা’ নজরদারিতে রয়েছেন। তাঁরা আত্মগোপনে থেকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার পুরো কর্মকাণ্ড মনিটর করা হচ্ছে। সরকারের হাইকমান্ড বিষয়গুলো দেখভাল করছে। বিএনপি নেতা কাইয়ুম কিভাবে দেশের বাইরে চলে গেছেন তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের গাফিলতি ছিল কি না তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা : সূত্র জানায়, বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়টি মন্ত্রীদের জানান।

বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বড় ভাইদের ব্যাপারে বিস্তারিত কথা হয়েছে। মোবাইল ট্র্যাক করে এবং কথোপকথনের রেকর্ড যাচাই-বাছাই করে পুলিশ ও র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে, এই ‘বড় ভাইদের’ নির্দেশেই দুই বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, ‘বড় ভাইদের’ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁদের আইনের আওতায় আনতে কোনো বাধা থাকবে না। তাঁদের নজরদারির আওতায় আনতে বলা হয়েছে। তবে অনর্থক কাউকে হয়রানি করা যাবে না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, কুনিও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। কার নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটনো হয়েছে তা উদ্ঘাটিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় সামনে রেখে দেশে আরো বড় ধরনের নাশকতা হতে পারে বলে বৈঠকে তথ্য উপস্থাপন করা হয়। তখন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো কঠোর নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযান আরো বাড়াতে হবে।

‘আমাকে বলির পাঁঠা বানাতে চায় সরকার’ : তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করছেন, তাভেল্লা খুনের পর দেশ ছেড়েছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাড্ডার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ুম। তবে কাইয়ুম দাবি করেছেন, ‘গত ২৮ এপ্রিল আমি দেশ ছেড়েছি। প্রায় ছয় মাস ধরে মালয়েশিয়ায় আছি।’ গত সোমবার তিনি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেছেন, সরকার তাঁকে বলির পাঁঠা বানাতে চায়। সরকার জজ মিয়া নাটক সাজাচ্ছে অভিযোগ করে তিনি দাবি করেন, ‘গত ২০ অক্টোবর তাঁর ছোট ভাই এম এ মতিনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে।’

নজরদারিতে কাইয়ুম : বিদেশে অবস্থান করলেও প্রধান সন্দেহভাজন এম এ কাইয়ুমের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন গোয়েন্দারা। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, খুনের ঘটনার আগে ও পরে টেলিফোনে কী কথা হয়েছে, তা জানতে একাধিক সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে তাঁরা জেনেছেন, দুবাইয়ে অবস্থানরত পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমাম হোসেন ও দুর্ধর্ষ কিলার জিসানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কাইয়ুম। ২০০৭ সালে সহযোগীদের নিয়ে মালিবাগের একটি আবাসিক হোটেলে গুলি করে হত্যা করেছিল গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নুরুল আলম শিকদার ও উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেন তালুকদারকে।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাইয়ুমের সঙ্গে জিসানের একাধিকবার কথা হয়েছে। তাভেল্লা হত্যার ব্যাপারে কাইয়ুম-জিসানের কথোপকথন সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। বিদেশি হত্যাকাণ্ডে জিসানের লোকজন জড়িত আছে। রিমান্ডে থাকা তিন আসামির কাছ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তারা কাইয়ুম ও তাঁর ভাইসহ অন্য বিএনপি নেতা এবং জামায়াতের লোকজনের তথ্যও জানিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।

কুনিও হত্যায় সন্দেহভাজনরা নজরদারিতে : কুনিও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রংপুর শাখার সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস ছালাম জানান, খুনিদের গ্রেপ্তার ও মোটিভ নিশ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ অনেক দূর এগিয়েছে। এখন জাল গুটিয়ে ফেলার পালা।

কুনিও হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন-অর-রশিদকে গত শনিবার তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন মামলা তদন্ত করছেন কাউনিয়া থানার নতুন ওসি এ বি এম জাহিদুল ইসলাম। এর আগে এই মামলার বাদী কাউনিয়া থানার ওসি রেজাউল করিমকে পীরগঞ্জ থানায় বদলি করা হয়।

হত্যাকাণ্ড তদন্তে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ মামলার তদন্ত চলছে।



মন্তব্য চালু নেই